উলুবেড়িয়া পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান এসেছে? মঞ্চ থেকে জানতে চাইলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভিড় থিকথিকে নেতাজি ইন্ডোর তখন খুঁজছে কে সেই ব্যক্তি! মমতা ফের বলে উঠলেন, ‘‘দেখি তো চেহারাটা!’’ অসংখ্য কালো মাথার মাঝে বেশ কিছুটা পিছন থেকে উঠে দাঁড়ালেন সাদা হাফ শার্ট, বাদামী ট্রাউজার্সের শীর্ণকায়।
নেত্রী তাঁকে বললেন, ‘‘তোমার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ কেন? বাড়ি করতে গেলে তোমায় টাকা দিতে হবে? তুমি বরং ইস্তফা দিয়ে ঘর বসে থাক। ববি (পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম) দেখে নেবে বিষয়টা।’’ প্রায় হাজার পনেরো নেতা, কর্মী ভরা সভায় নেত্রীর তিরস্কারের মুখে মাথা নীচু উলুবেড়িয়া পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান আব্বাসউদ্দিন খানের। জনপ্রতিনিধি হয়ে তোলাবাজির জন্য কড়া ভর্ৎসনা করেও সংশোধনের সময় দিলেন তৃণমূল নেত্রী। বললেন, ‘‘ওকে সাত দিন সময় দাও। সাত দিনে নিজেকে না শোধরালে দল ব্যবস্থা নেবে।’’
কড়া ভর্ৎসনার মুখে কোনও উত্তর দিতে পারেননি কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাসও। নদিয়ার বিভিন্ন জায়গায় পঞ্চায়েতের ফল নিয়ে অসন্তোষের কথা বলতে বলতেই খোঁজ করেন কৃষ্ণনগর দক্ষিণের বিধায়ক উজ্জ্বলবাবুর। নেত্রীর পিছনেই মঞ্চে বসে থাকা উজ্জ্বলবাবু দাঁড়িয়ে উঠতেই নেত্রীর ঝাঁঝালো কণ্ঠ, ‘‘উজ্জ্বল তুমি কি মন্ত্রী! কী কাজ কর?’’ মঞ্চে এক সারিতেই বসা নদিয়ার জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তকেও ধমকে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘কী গৌরীদা, আপনারা তো ভাল করতে পারেননি।’’ হাল্কা মাথা নাড়লেন গৌরীবাবু। মুহূর্তে খোঁজ পড়ল নাকাশিপাড়ার বিধায়ক কল্লোল খাঁ-র। মঞ্চের সামনে বসা কল্লোলবাবু দাঁড়াতেই মমতার সপাট প্রশ্ন, ‘‘ফল খারাপ হল কেন?’’ জবাব নেই। জেলার ফলে তাঁর অসন্তুষ্টি বুঝিয়ে তৃণমূল নেত্রী জানান, দিন কয়েক পরেই কৃষ্ণনগরে ফিরহাদ, শুভেন্দু অধিকারী, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য সভা করবেন।
এ বার পালা উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী কোচবিহারের রবীন্দ্রনাথ ঘোষের। মমতা তাঁকে বলেন, ‘‘মাথা ঠান্ডা কর। নেতা হলে সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। মিহির (গোস্বামী), উদয়ন (গুহ) সবাইকে নিয়ে চলতে হবে।’’
ঝাড়গ্রামের ফলে তৃণমূল যে বিড়ম্বিত, তা বুঝিয়ে জেলা সভাপতি অজিত মাইতিকে মমতার নির্দেশ, ‘‘বি স্ট্রং।’’ পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্যান্য নেতা দীনেন রায়, প্রদ্যুৎ ঘোষ, আশিস চক্রবর্তী, সৌমেন মহাপাত্রদের নাম ধরে ধরে দাঁড় করান। পশ্চিম মেদিনীপুরে তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্বে ফল যে খারাপ হয়েছে, তা স্পষ্ট করেই মমতা বলেন, ‘‘অজিত, দীনেন, প্রদ্যুৎ, আশিস, সৌমেনকে নিয়ে কোর গ্রুপ করে দিলাম। কেশিয়ারি, শালবনি, গোয়ালতোড়ে কেন ফল খারাপ হয়েছে, ১০ দিনের মধ্যে দেখে নিয়ে আমাকে রিপোর্ট দেবে।’’
আরও পড়ুন: শিক্ষক পুরস্কারেও বঞ্চনার অভিযোগ
শালবনির বিধায়কের খোঁজ পড়তেই উঠে দাঁড়ান সাদা ফুলশার্ট, ট্রাউজার্সের শ্রীকান্ত মাহাতো। মমতা জানতে চান, ‘‘তোর ব্লকে কী ভাবে খারাপ হল? তুই ঝাড়গ্রামে বিধায়কও থাকবি আবার ঝাড়খন্ডের সাংসদও হবি, কী ভাবে হবে? আগে নিজের ব্লকটা সামলা।’’
পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখে ভর্ৎসনার পর্বশেষেই দলের শাখা সংগঠনগুলির নেতাদের ধমকালেন মমতা। দলের সংখ্যালঘু সংগঠনের সভাপতির নাম জানতে চাইতেই উঠে দাঁড়ান হাজি নুরুল। মমতার রাগত প্রশ্ন, ‘‘কী শুধু সভাপতি হয়ে বসে আছ, না জেলাগুলোও দেখ?’’ নুরুল চুপ। মমতা খোঁজ নিলেন খেতমজুর সংগঠনের প্রধান বেচারাম মান্নার। তাঁকেও একই নির্দেশ, ‘‘ব্লকগুলো ভাল করে দেখতে হবে।’’ মমতা খুঁজলেন দলের মহিলা শাখার সভানেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে। তাঁকেও বললেন, ‘‘শশীদের (শশী পাঁজা, শিশু ও নারীকল্যাণ মন্ত্রী) নিয়ে ব্লক পর্যন্ত কমিটিগুলো করতে হবে।’’
মন্ত্রী হয়েও কেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় দলের শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবেন, তা নিয়েও অসন্তোষ ব্যক্ত করেন মমতা। বলেন, ‘‘একসঙ্গে দশটা পদ নিতে হবে না। মন্ত্রী, সাংসদ হব, আবার শ্রমিক সংগঠনও করব, তা হলে বাকিরা কী করবে? ভাগাভাগি করে চালাতে হবে।’’
তুলনায় ‘ভাগ্য’ প্রসন্ন মলয় ঘটকের। শ্রমমন্ত্রী হয়েও তিনি শ্রমিক সংগঠনের কাজে ‘সাহায্য’ করার দায়িত্ব তো পেলেনই, সেই সঙ্গে আসানসোলের মেয়র জিতেন তিওয়ারিকে সতর্ক করে নেত্রী জানিয়ে দিলেন, তাঁকে মলয়বাবুর সঙ্গে ‘সু-সম্পর্ক’ রেখে কাজ করতে হবে।