মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
শনিবার নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি অভিযোগ করেন, মাত্র পাঁচ মিনিট বলার পরেই তাঁর মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তা নিয়ে সোমবার বিধানসভাতেও সরব হলেন মমতা। বললেন, ‘‘চন্দ্রবাবু-সহ বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীদের ২০-২৫ মিনিট করে বলতে দেওয়া হল। কিন্তু আমার বেলায় চার থেকে পাঁচ মিনিট পরেই মাইক বন্ধ করে দেওয়া হল।’’
উল্লেখ্য, শনিবার দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে নীতি আয়োগের বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে। সেখানে বিরোধী শিবিরের তরফে একমাত্র বাংলার মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। মাঝপথে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে আসেন মমতা। বলেছিলেন, ‘‘আমি বিরোধীদের পক্ষ থেকে একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী, যে এই বৈঠকে গিয়েছে। আমাকে মাত্র পাঁচ মিনিট বলতে দিল। তার পরেই মাইক বন্ধ করে দিল! আর কখনও নীতি আয়োগের বৈঠকে যাব না।’’ সঙ্গে এ-ও জানান, অসমের মুখ্যমন্ত্রী, গোয়া কিংবা ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রীকে অনেক ক্ষণ বলার সময় দেওয়া হয়েছিল। তাঁর বেলাতেই পাঁচ মিনিট পর মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেন্দ্রের তরফে মমতার এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পিআইবি জানিয়েছে, এই দাবি বিপথে চালিত করা। কারণ, মমতার মাইক বন্ধ করা হয়নি। তাঁর বলার সময় অতিক্রান্ত, ঘড়িতে শুধু তা দেখানো হয়েছিল। সতর্ক করতে কোনও বেলও বাজানো হয়নি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনও মমতার মন্তব্যের বিরোধিতা করেন।
বিধানসভায় শেষ হল মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা। তাঁর প্রস্তাবিত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানালেন স্পিকার।
জলবণ্টন নিয়ে কেন্দ্রীয় সেচ মন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলতে বিধানসভা থেকে কমিটি পাঠানোর প্রস্তাব করেন মমতা। সেই কমিটিতে যেন বিধায়ক সুমন কাঞ্জিলালকে পাঠানো হয়, তা-ও জানান। স্পিকার জানিয়েছেন, পরিষদীয় মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি গঠন করা হবে।’’
বাংলা ভাগ প্রসঙ্গে বিধানসভায় মমতা বলেন, ‘‘১ লক্ষ ৬৪ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা উত্তরবঙ্গের পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ করা হয়েছে। ভোটের সময় বিজেপি ভাগ করার জন্য ভোট দিতে বলে। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আলোচনা হোক বিধানসভায়। ভোটাভুটি হোক। বিধানসভাকে এড়িয়ে বাংলা ভাগ করার কথা বলা যাবে না।’’
গঙ্গাসাগর মেলাকে কেন জাতীয় মেলা ঘোষণা করা হচ্ছে না, বিধানসভায় সেই প্রশ্ন তোলেন মমতা। বলেন, ‘‘কুম্ভ জাতীয় মেলা। কিন্তু গঙ্গাসাগরকে এখনও জাতীয় মেলা বলে ঘোষণা করা হয়নি। কেন হবে না?’’
সুন্দরবন মাস্টারপ্ল্যানের কথা নীতি আয়োগের বৈঠকে জানিয়ে এসেছেন, বিধানসভায় বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান এখনও ঝুলে আছে। ৭০০ কোটি টাকা খরচ করেছি। ডিপিআর হয়ে গিয়েছে। এতে ঘাটাল এবং হুগলির মানুষ বাঁচবেন। পাশাপাশি সুন্দরবন মাস্টারপ্ল্যানের কথাও আমি বলে এসেছি বৈঠকে। মুড়িগঙ্গার উপর দিয়ে সেতু তৈরি হবে।’’
মাইক বন্ধ নিয়ে আবার বিধানসভায় সরব মমতা। বললেন, ‘‘চন্দ্রবাবুদের ২০-২৫ মিনিট করে বলতে দেওয়া হল নীতি আয়োগের বৈঠকে। আমার বেলায় পাঁচ মিনিটে মাইক বন্ধ করে দেওয়া হল!’’
মমতা বলেন, ‘‘জল সমস্যার সমাধান আমরাই বলে দিচ্ছি। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। তাঁর সঙ্গে কথা বললেই সব মিটে যাবে।’’
মমতা বলেন, ‘‘৫০০ কোটি টাকার বাঁধ তৈরি করেছি আমরা। ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পে পাঁচ লাখের বেশি পুকুর কেটেছি। ২২৩২ কোটি টাকা খরচ করে লোয়ার দামোদর বেসিন করেছি। এতে বর্ধমানে বন্যা কমবে। ডিভিসিকেও শুনলাম নাকি বেসরকারি করে দিচ্ছে? সবই বিক্রি করে দেবে।’’
ঝাড়খণ্ড, বিহারে বন্যা হলে বাংলায় নদীর পাড় ভাঙছে। বিধানসভায় বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘ফারাক্কা ব্যারেজ কমিউনিটি মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নির্ভরশীল। আমি বাংলার স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেব। কারণ এখানকার মানুষ আমাকে নির্বাচিত করেছে। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে অগ্রিম চুক্তি করে নিচ্ছে কেন্দ্র। বাংলা কোনও আলোচনায় অংশ পাচ্ছে না। ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশে বন্যা হলে প্রতি বছর মালদহে ভাঙন দেখা দেয়। ২০০৫ সাল থেকে ৩৩৭৩ হেক্টর জমি নদীতে তলিয়ে গিয়েছে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করার সময়ে জ্য়োতি বসুর সঙ্গে আলোচনা করেছিল কেন্দ্র। এখন বাংলা পুরোপুরি বাদ!’’
বাংলা ভাগ করতে এলে কী ভাবে তা রুখতে হয়, তিনি দেখিয়ে দেবেন। বিধানসভায় বললেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘চার মন্ত্রী বলেছেন উত্তরবঙ্গ ভাগের কথা। আমি ধিক্কার জানাই। আসুক বাংলা ভাগ করতে, কী করে রুখতে হয় দেখিয়ে দেব।’’
বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ভারত-বাংলাদেশ নদী কমিশনের আদলে ভারত-ভুটান নদী কমিশন করার কথা নীতি আয়োগের বৈঠকে আমি বলে এসেছি। তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে একতরফা ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি সরকার।’’
প্রতি বছর ডিভিসির জল ছাড়ার কারণেই বাংলা প্লাবিত হয়, বিধানসভায় যা নিয়ে আরও এক বার ক্ষোভপ্রকাশ করলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘প্রতি বছর ডিভিসি জল ছাড়ে বলে বাংলার একাধিক জেলা ভেসে যায়। জলচুক্তি নিয়ে আমি আমার অবস্থান দিল্লিতে জানিয়ে এসেছি। বন্যার জন্য প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে টাকা দেওয়া হল। আমার রাজ্যকে দেওয়া হল না। ভুটান জল ছাড়লে কেন্দ্রকে সে কথা জানানো হয়। রাজ্যকে জানানো হয় না। বন্যায় বাংলার বনভূমি, চা-বাগান ভেসে যাচ্ছে।’’
বাজেটে বাংলা তথা উত্তরবঙ্গকে বঞ্চনা নিয়ে বিধানসভায় সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গ থেকে এত আসন পেল ওরা, তবু বাজেটে কিছু দিল না! এখন আবার বিভাজনের রাজনীতি করছে।’’
জলসমস্যা নিয়ে বিধানসভার কমিটি কেন্দ্রের সেচ মন্ত্রকের কাছে যাক, বিধানসভার অধিবেশনে এমনটাই মন্তব্য করলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘জল নিয়ে বিধানসভায় আলোচনার কপি তৃণমূলের লোকসভা এবং রাজ্যসভার সাংসদদের কাছে পাঠানো হোক। তাঁরাও যেন এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন।’’
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘নীতি আয়োগের বৈঠকে ইন্দো-ভুটান নদী কমিশন নিয়ে বিশদে কথা বলে এসেছি। বাংলা হল নৌকার মতো। সব জল আমাদের রাজ্যে এসে পড়ে। আমাদের ভুগতে হয়। বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে রেকর্ড করে এসেছি।’’
বাংলা ভাগ প্রসঙ্গে ক্ষোভপ্রকাশ করে বিধানসভায় মমতা বলেন, ‘‘ভোট চলে গেলেই ভাগাভাগি ইস্যুকে নিয়ে আসা হয়। এক জন বলছেন, মুর্শিদাবাদ-মালদহ ভেঙে দাও। কেউ বলছেন, অসমের তিনটি জেলাকে নিয়ে নতুন কিছু করো। কেউ আবার উত্তরবঙ্গকে উত্তর-পূর্বের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে বলছেন।’’
নীতি আয়োগের ঘটনা নিয়ে সোমবার বিধানসভায় নিন্দাপ্রস্তাব আনা হয়। তা সমর্থন করেন মুখ্যমন্ত্রী।