আগামী ৩০ এপ্রিল, অক্ষয় তৃতীয়ায় দিঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ ধামের উদ্বোধন। জগন্নাথ মন্দিরে বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার কথা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আগের দিন, অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল হবে বিশেষ হোমযজ্ঞ। তার আগে নিরাপত্তাবলয়ে মুড়ে ফেলা হল সৈকতনগরীকে। বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে গোটা দিঘা জুড়ে। নজরদারি শুরু হয়েছে দিঘা গেট এবং ও়ড়িশা সীমানাতেও।
২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর দিঘায় সমুদ্র সৈকত ধরে ওল্ড দিঘা থেকে নিউ দিঘার দিকে বেড়াতে যাওয়ার সময়ে জগন্নাথদেবের একটি মন্দির প্রথম বার নজরে আসে মুখ্যমন্ত্রী মমতার। এর পর সেই দিনই সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে দিঘাতেও জগন্নাথ মন্দির গড়ে তোলা হবে।
মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব বর্তায় দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের উপর। শুরু হয় জমি খোঁজা। প্রথমে দিঘা থানার উল্টো দিকে সমুদ্রের ধারে জগন্নাথ ঘাটের কাছেই একটি চিহ্নিত করা হয়েছিল নতুন মন্দির নির্মাণের জন্য। পরে সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়। ২০১৯ সালে নিউ দিঘা রেলস্টেশনের পূর্ব দিকে সমুদ্রতট থেকে প্রায় ৩৬০ মিটার উত্তরে ভগীব্রহ্মপুর মৌজার ২০ একর জায়গা জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের জন্য চিহ্নিত করা হয়। পরে সেই জমি দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ হিডকোর হাতে তুলে দেয়। সেখানেই মন্দিরটি তৈরি হয়েছে।
দিঘার জগন্নাথ মন্দিরটি সম্পূর্ণ ভাবেই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অনুকরণে তৈরি হয়েছে। এই মন্দিরের নির্মাণশৈলীতে পুরীর মতোই উত্তর ভারতীয় নাগারা স্থাপত্যের অনুসরণে কলিঙ্গ আর্ট স্থাপত্যের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যাবে। এই মন্দির নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে রাজস্থানের বংশীপাহাড়পুরের বেলেপাথর। রাজস্থান এবং ওড়িশার প্রায় ৪০০ শ্রমিক জগন্নাথদেবের মন্দিরটি নির্মাণ করেছেন। তবে পুরীর মন্দিরে মূল বিগ্রহটি নিম কাঠের হলেও, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে পূজিত হবে পাথরের মূর্তি। কাঠের মূর্তি এখানেও থাকছে, যা রথে চড়ে মাসির বাড়িতে যাবে।
পুরোনো জগন্নাথ মন্দিরটিকেও জগন্নাথের মাসির বাড়ি হিসাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। রথযাত্রার সময় নবনির্মিত মন্দির থেকে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা রথে চেপে মাসির বাড়িতে যাবেন। এর জন্য নতুন জগন্নাথ মন্দির থেকে পুরোনো জগন্নাথ মন্দির পর্যন্ত রাস্তাটিকে আরও বেশি চওড়া করে সাজানো হয়েছে।
মন্দিরের মূল প্রবেশপথের সামনে ১১৬বি জাতীয় সড়কের উপর তৈরি হচ্ছে চৈতন্যদ্বার। এই চৈতন্যদ্বার পেরোলেই জগন্নাথদেবের মূল মন্দিরের প্রবেশদ্বার। স্যান্ডস্টোন বা বেলেপাথরে নকশাখচিত মূল প্রবেশদ্বারটির মাঝের অংশ অপেক্ষাকৃত উঁচু (১০ মিটার) এবং দু’দিকের অংশ অপেক্ষাকৃত নীচু (৮.৫ মিটার)। ওই ফটক দিয়ে ঢুকলেই দু’দিকে ১১টি করে পিলার সম্বলিত রোডশেড তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে এগিয়ে গেলে দু’দিকে রয়েছে দিয়াস্তম্ভ। আরও কিছুটা গেলে দেখা যাবে অরুণস্তম্ভ। প্রায় ১০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট অরুণ স্তম্ভটি তৈরি হয়েছে কালো গ্রানাইট পাথর দিয়ে।
অরুণস্তম্ভ পেরিয়ে গেলেই সামনে রয়েছে সিংহদ্বার বা গোপুরম ১। সিংহদ্বারের বাইরে দরজার পাহারায় রয়েছে জয়-বিজয়। তাঁদের মাঝে রয়েছেন নবরত্ন (ন’জন দেবদেবী)। সিংহদ্বারের কাঠের প্রবেশদ্বারের উপরে রয়েছে কালো গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি গজলক্ষ্মী। যার দু’দিকে রয়েছে দুই নর্তকী এবং দেবদাসী। সিংহদ্বারের ভিতরের অংশ পুরোটাই ভিয়েতনাম মার্বেল দিয়ে সাজানো। ভিতরে রয়েছে জগন্নাথদেবের পতিতপাবন মূর্তি। পাশের দেওয়ালের দিকে হনুমানের একটি মূর্তিও রয়েছে।
খানিক সামনে এগিয়ে গেলে রয়েছে পদ্মকুণ্ড। পদ্মকুণ্ডের চারদিকে ফাঁকা চাতাল। সেখানে নামার জন্য সিঁড়িও রয়েছে। এই চাতালে জগন্নাথদেবের আরাধনা করা যাবে। সামনে এগিয়ে গেলে পড়বে গোপুরম ২, যা গোপুরম ১-এর মতোই দেখতে অনেকটা। এখানে পূজিত হবে অনন্তনাগ। এটিকে অনন্ত বাসুদেবের মন্দিরও বলা হয়। এর পর এগিয়ে গেলে ধাপে ধাপে পৌঁছোনো যাবে মূল মন্দিরের ভোগমণ্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন এবং গর্ভগৃহ।
ভোগমণ্ডপের দেওয়ালে রয়েছে ৫৬টি পদ্মের চক্রের নিশান। ভোগমণ্ডপের প্রতিটি দেওয়ালে রয়েছে একটি করে স্টোররুম ও ছোট ছোট ছ’টি দরজা। এখানে জগন্নাথদেবকে ভোগ দেওয়া হবে। ভোগমণ্ডপে রয়েছে তিনটি হাতির কাঠামো। ফটকের উপরে রয়েছে গ্রানাইটের নবগ্রহ।
সামনেই নাটমন্দির। সেখানে রয়েছে গরুড়স্তম্ভ। নাচ, গান, কীর্তনের আসর বসবে সেখানে। এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে, গরুড় সরাসরি জগন্নাথ বলরাম এবং সুভদ্রাকে দেখতে পান। উপরে রয়েছে সাতটি ঝাড়বাতি। নাটমন্দিরে গ্রানাইট পাথরে তৈরি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের মূর্তি রয়েছে।
নাটমন্দিরের পরেই জগমোহন, যা মূলত বলরামদেবের মন্দির। এই মন্দিরের দক্ষিণ দরজায় দু’টি অশ্বের মূর্তি বসানো হয়েছে। তাই ওই দরজার নাম অশ্বদ্বার। নাটমন্দিরের উত্তর দিকের দরজায় রয়েছে দু’টি হাতির মূর্তি। তাই ওই দুয়ারের নাম হস্তিদুয়ার। জগমোহনের ভিতরে চারটি বড় বড় স্তম্ভ রয়েছে। উপর দিকটা গম্বুজের মতো।
সব শেষে রয়েছে মূল মন্দির বা গর্ভগৃহ। এটি প্রায় ৬৫ মিটার উঁচু। এই গর্ভগৃহে গেলে দেখা যাবে রত্নবেদী, যেখানে অধিষ্ঠিত হবেন জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা। গত মার্চে রাজস্থান থেকে আসা ওই মূর্তিগুলিকে রত্নবেদীর উপর তোলার কাজ শেষ হয়েছে। অক্ষয় তৃতীয়ার শুভলগ্নে ওই মূর্তিগুলিই প্রাণপ্রতিষ্ঠা পাবে।
মন্দির কর্তৃপক্ষ সূত্রে খবর, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন জগন্নাথ মন্দিরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও, উপাচার শুরু হয়ে গিয়েছে কয়েক দিন আগে থেকেই। পুরীর মন্দিরের রাজেশ দয়িতাপতির নেতৃত্বে শুরু হয়েছে শান্তিযজ্ঞ। রয়েছেন ইসকনের সহ-সভাপতি রাধারমণ দাসও। ইসকনের বিভিন্ন শাখার অন্তত ৬০ জন ভক্তও মাঙ্গলিক কাজে হাত লাগিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার থেকে প্রায় এক কোটি মন্ত্রোচ্চারণের লক্ষ্যে চারটি কুণ্ডের মাঝে মহাকুণ্ড জ্বালিয়ে চলছে যজ্ঞ। গর্ভগৃহে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবতাকে আহ্বান জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে জগন্নাথদেবের বসার পিঁড়ির পুজো। দুগ্ধস্নান সম্পন্ন হয়েছে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা এবং সুদর্শনের। লক্ষ্মী, বিমলা, সত্যভামা-সহ সমস্ত দেবদেবীর মূর্তিকেও দুগ্ধস্নান করানো হয়েছে।
দিঘা জুড়ে মাইকে বাজছে মাঙ্গলিক সানাইয়ের সুর। ২৯ তারিখ হবে মহাযজ্ঞ। ওই দিন পর্যন্ত রোজই হোমযজ্ঞ চলবে বলে মন্দির সূত্রে খবর।