বিতণ্ডার পর পরস্পরকে সৌজন্য দেখালেন মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতা। —ফাইল চিত্র।
শুরু হয়েছিল তুমুল তরজা দিয়ে। শেষ হল সৌজন্যের নমস্কারে। সাক্ষী রইল সোমবারের রাজ্য বিধানসভা। গত কয়েকদিনে যখন তৃণমূল বনাম বিজেপির বিতণ্ডা শালীনতার সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে, তখন রাজ্য বিধানসভায় দেখা গেল রাজনৈতিক সৌজন্যও। যার সূচনা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মার্জিত প্রতিক্রিয়া এল বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর তরফেও। ঘটনাচক্রে, যাঁরা ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে এবং সোমবার অধিবেশনের মধ্যেও পরস্পরের বিরুদ্ধে যুযুধান ছিলেন, তাঁরা সভাকক্ষে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে নমস্কার এবং প্রতি নমস্কার বিনিময় করলেন।
সোমবার বিধানসভায় তৃণমূলের আনা নিন্দাপ্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটির সময় তৃণমূলের বিধায়কদের সঙ্গে নিয়ে বিরোধী বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গিয়ে বিধায়কদের উদ্দেশে হাত জোড় করে নমস্কার জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁর সঙ্গেই বিরোধী বিধায়কদের নমস্কার জানান শাসকপক্ষের বিধায়কেরা। শাসকপক্ষের বিধায়কদের প্রতি নমস্কার জানান বিরোধীপক্ষের বিধায়কেরাও। তখনই মুখ্যমন্ত্রীকেও নমস্কার করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। মুখ্যমন্ত্রীও পাল্টা নমস্কার করেন তাঁকে।
ঘটনাচক্রে, তার কিছু আগেই মুখ্যমন্ত্রী বনাম বিরোধী দলনেতা সরাসরি বিতণ্ডা দেখেছে রাজ্য বিধানসভা। তথ্যাভিজ্ঞেরা বলছেন, গতবছর বিধানসভা ভোটের পর এই প্রথম মুখোমুখি বাগ্বিতণ্ডা হল মমতা-শুভেন্দুর। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে আনা রাজ্যের নিন্দাপ্রস্তাব নিয়ে সোমবার শুরু থেকেই সরগরম ছিল রাজ্য বিধানসভা। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু স্পষ্টই বলেন, এ সব প্রস্তাব এনে লাভ হবে না। তদন্তে তার কোনও প্রভাব পড়বে না।’’ পাল্টা তাঁর দিকেই আঙুল তোলেন মমতা। প্রশ্ন তোলেন, নারদা-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পরেও কেন বিরোধী দলনেতার বাড়িতে তল্লাশি করেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল? কেমন ছিল সেই বাগ্বিতণ্ডা?
শুভেন্দু: আপনারা বিএসএফ-সহ একাধিক বিষয়ে প্রস্তাব এনেছেন। সব শূন্য হয়েছে! এটাও শূন্য হবে! এই প্রস্তাবে তদন্তে কোনও প্রভাব পড়বে না। ‘চোর ধরো জেল ভরো’ চলবে!
মমতা: একটা রেজোলিউশন (প্রস্তাব) সরকার আনতেই পারে। এটা কৃতদাসদের সরকার নয়! স্বাধীনচেতা সরকার! এখন আর গাঁধী-নেতাজির নাম নেই। রবি ঠাকুরের নাম নেই। গেরুয়া সেজে বসেছেন চোর! দেখে নেবে বলছে! ২০২৪ একেবারে যাবে। যারা গ্যাস বেলুনের মতো ফুলেছ, শেষ হয়ে যাবে। নিরপেক্ষতা আনতে এই প্রস্তাব।
এর পর সরাসরি শুভেন্দুকেই তীব্র কটাক্ষ করেন মমতা। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘মধ্যরাতে কারও কারও বাড়ি চলে যাচ্ছে! তৃণমূলে থাকলে চোর! বিজেপিতে গেলে ওয়াশিং মেশিন! নারদ কেসে বিরোধী দলনেতার বাড়িতে কটা রেড হয়েছে?’’ মুখ্যমন্ত্রী ওই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সভাকক্ষে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন বিজেপি বিধায়করা। শুভেন্দু বলেন, তিনি দুর্নীতি প্রমাণ করে দেখাবেন।
মমতা: প্রমাণ করে দেখান! ডোন্ট টাচ মাই বডি!
শুভেন্দু: ২৪ ঘণ্টা সময় দিক। দেখিয়ে দেব।
মমতা: কোথা থেকে কী বার হবে? সিআইডি এবং ডিজিকে আমি নিয়োগ করি না। তারা ভাল করছে। আমি সিবিআইকে খারাপ বলছি না। তারা নিরপেক্ষ তদন্ত করুক। সিবিআই এখন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে নেই। স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীনে আছে। আমি বিশ্বাস করি না নরেন্দ্র মোদী করছেন!
আরও এক বার শুভেন্দু-সহ বিজেপি নেতাদের দিকে আঙুল তুলে মমতা খোঁচা দেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিজেপি নেতারা এ সব করছেন। তোমরা বুনো ওল হলে আমি বাঁঘা তেঁতুল! তৃণমূল নয়, পুলিশকেও সহ্য করতে পারে না।’’ এর পরে মুখ্যমন্ত্রী নিশানা করেন বিজেপির বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালকে। বাংলায় কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নয়ছয় হয় অভিযোগ করে বিজেপির বিধায়ক দাবি করেছিলেন, ওই কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বন্ধ করা হোক। সেই নিয়েই অগ্নিমিত্রাকে পাল্টা কটাক্ষ করেন মমতা। আসানসোলের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা। মুখ্যমন্ত্রী এলাকার প্রসঙ্গ তুলেই বলেন, ‘‘আসানসোলে হেরেও লজ্জা নেই! বলছে, বাংলার বাড়ি বন্ধ করে দাও। তোমরা বন্ধ করলেও বাংলা থামবে না। প্রধানমন্ত্রীকে সাবধান করছি! এঁরা বাংলার টাকা দিতে বারণ করেন।’’ প্রসঙ্গত, আসানসোল লোকসভার উপনির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতেছে তৃণমূল। এই প্রথম ওই লোকসভা আসনটি পেয়েছে তারা।
পেগাসাস অ্যাপের মাধ্যমে বিরোধী নেতাদের উপর নজরদারির অভিযোগ উঠেছিল মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। সেই নিয়েও সরব হন মমতা। বলেন, ‘‘পেগাসাস দিয়ে আপনারাও ছাড় পাবেন না। সব মন্ত্রী, সাংসদ, আধিকারিকের ফোন ট্যাপ হয়েছে। জন্মদিন (১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী মোদীর জন্মদিন ছিল), তাই কিছু বললাম না। চিতাবাঘকে সম্মান করি। মিউমিউকে সম্মান করি না। মুসোলিনির থেকেও খারাপ এরা। সিবিআইয়ের ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, ‘‘রবি ঠাকুরের নোবেল এখনও পর্যন্ত আনতে পারেনি। নন্দীগ্রাম, নেতাই কেসে কিছু করতে পারেনি সিবিআই। ওদের সাকসেস রেট (সাফল্যের হার) কম।’’
এর পরেই নিন্দাপ্রস্তাবটি নিয়ে বিধানসভায় শুরু হয় ভোটাভুটি। সংখ্যার হিসেবে শাসক তৃমমূলের সহজেই ওই ভোটাভুটিতে জয়লাভ করার কথা ছিল। বাস্তবে অন্য কিছু হয়নি। ভোটাভুটির সময়েই তৃণমূল বিধায়কদের সঙ্গে নিয়ে বিজেপি বিধায়কদের আসনের কাছে এগিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা। হাত জোড় করে নমস্কার করেন। সৌজন্যের খামতি রাখেননি বিজেপি বিধায়করাও। পাল্টা সৌজন্য দেখিয়ে নমস্কার করেন তাঁরা। যে বিরোধী দলনেতার সঙ্গে বিতণ্ডা হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর, সেই শুভেন্দুও এগিয়ে এসে প্রতি নমস্কার জানান। পাল্টা নমস্কার করেন মমতাও।