নিজেরা কিছু করবেন না, পুলিশকে বলছে উপরতলা

জেলার পুরভোটও যেন কলকাতার মতো ‘শান্তিপূর্ণ’ হয়! খোদ মুখ্যমন্ত্রীর তা-ই নির্দেশ। যে কলকাতা পুরভোটে গুলি খেলেন এক সাব-ইনস্পেক্টর, তাকেই শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শান্তিপূর্ণ’ বলে আখ্যা দিলেন। কলকাতার মতো করে ভোট করাতে বললেন জেলার ৯১টি পুরসভায়। ফলে শনিবার কী করতে হবে আর কী করতে হবে না, ঠিক করতে গিয়েই ঘুম ছুটছে পুলিশের।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪১
Share:

জেলার পুরভোটও যেন কলকাতার মতো ‘শান্তিপূর্ণ’ হয়! খোদ মুখ্যমন্ত্রীর তা-ই নির্দেশ।

Advertisement

যে কলকাতা পুরভোটে গুলি খেলেন এক সাব-ইনস্পেক্টর, তাকেই শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শান্তিপূর্ণ’ বলে আখ্যা দিলেন। কলকাতার মতো করে ভোট করাতে বললেন জেলার ৯১টি পুরসভায়। ফলে শনিবার কী করতে হবে আর কী করতে হবে না, ঠিক করতে গিয়েই ঘুম ছুটছে পুলিশের।

জেলায় জেলায় পুলিশের নানা স্তরের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, তাঁদের প্রতি ‘গাইডলাইন’ হল— আপত্তিকর কিছু দেখলে কন্ট্রোলকে জানাতে হবে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত বড়কর্তারাই নেবেন।

Advertisement

এর অর্থ কী? উত্তর ২৪ পরগনার এক পুলিশকর্মী ব্যাখ্যা করলেন, মারামারি হচ্ছে দেখলে আগ বাড়িয়ে থামানোর চেষ্টা করবে না পুলিশ। জানাবে আইসি বা ওসিকে। ওসি দরকার বুঝে মোবাইল ভ্যান পাঠাবেন, না হলে জানাবেন এসডিপিওকে। তিনিও প্রয়োজন বুঝে পুলিশ ফোর্স পাঠাবেন, না হলে ফের উপরমহলে জানাবেন।

এর নিট ফল কী দাঁড়াবে? ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক প্রবীণ পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘কন্ট্রোল রুমের নির্দেশের অপেক্ষায় অনেকটা সময় কেটে যাবে। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে যাবে।’’ একই কথা বলেন ঘাটালের পুলিশকর্মী, “এই নিয়ে ন’বার ভোটের ডিউটি করছি। বুথ দখল হলে বুথের দায়িত্বে থাকা পুলিশ, আধিকারিকদেরই তা রুখতে হয়। কন্ট্রোল রুমে খবর দিয়ে পুলিশ আসতে আসতে যা ঘটার, তা ঘটেই যাবে।”

বিরোধীরা যদি অভিযোগ করেন, বুথের ভিতরে বিরোধী এজেন্টকে তুলে দিয়ে ছাপ্পা ভোট হচ্ছে? দক্ষিণ শহরতলির এক সাব-ইনস্পেক্টর জানান— তার জন্যও নির্দেশ এসে গিয়েছে। বলা হয়েছে, ‘‘ঠান্ডা মাথায় বোঝান, বুথের ভিতরে ঘটনা ঘটলে পুলিশের করার কিছু নেই। রিটার্নিং অফিসারকে জানাতে বলুন। নিজেরা কিছু করতে যাবেন না।’’

সুতরাং পুলিশ কর্মীরা ধরেই নিচ্ছেন, বুথের ভিতরে বা বাইরে বড় রকম গণ্ডগোল বাধলে বড়কর্তাদের কোর্টে বল ঠেলে নীরব দর্শক হয়েই থাকতে হবে তাঁদের। আর খুচরো বা মাঝারি ঝামেলার ক্ষেত্রে কী করণীয়? নিচুতলার কর্মীদের নিয়ে ব্রিফিংয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন দক্ষিণবঙ্গের এক পুলিশ কর্তা। এক পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘ওই কর্তা খোলাখুলি আমাদের বললেন, ‘মেরে তক কোই অ্যালিগেশন (অভিযোগ) নেহি আনা চাহিয়ে। অগর কোই রিউমর (গুজব) উঠে তো ওহি খতম কর দেনা।’’ তার মানে? ‘‘শাসক দল অভিযোগ করলে সেটা ‘অ্যালিগেশন’, আর বিরোধীরা অভিযোগ করলে সেটা ‘রিউমর’। গুজবকে উড়িয়ে দিতে হবে ঘটনাস্থলেই,’’ ব্যাখ্যা করলেন তিনি। পূর্ব মেদিনীপুরের এক ইনস্পেক্টর বললেন, ‘‘হিসেবটা পরিষ্কার। অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করতে হবে। তেমন চেঁচামেচি বাড়লে সামান্য কিছু অ্যাকশন নিতে হবে। যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে।’’

ভোটের দিন রাজ্য জুড়ে এই ‘ব্যালান্সে’র খেলাটাই দেখাতে হবে তাদের, বুঝে গিয়েছে নিচুমহল। প্রতিক্রিয়া? পুলিশ মহল কার্যত দু’ভাগ। একটা বড় অংশই মন থেকে মানতে পারছেন না উপরমহলের নির্দেশ। কিন্তু প্রাণের ভয় আছে, চাকরি বাঁচানোর তাগিদ আছে। তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিচ্ছেন সব। আর বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, পুলিশের আর একটি অংশ শাসক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েই চলছে।

শাসক দল তৃণমূল এবং পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ স্তর অবশ্য এ সব কোনও অভিযোগই স্বীকার করেনি। তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বিরোধীরা হালে পানি পাচ্ছেন না। প্রথমে তাঁরা সন্ত্রাস নিয়ে অভিযোগ করলেন। আদালতে গেলেন, নির্বাচন কমিশনে গেলেন, রাজ্যপালের কাছে গেলেন। কিন্তু জনতার আদালতে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না বলেই এখন পুলিশ নিয়েও অভিযোগ করছেন।’’ রাজ্য পুলিশের আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মার বক্তব্য, ‘‘অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচন করানোর সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। কেউ কোনও অভিযোগ করলে ভোটবিধি মেনে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো দক্ষ অফিসার আমাদের কম নেই। এর বাইরে কোনও মন্তব্য করব না।’’

কিন্তু পুলিশের অন্দরমহলে কান পাতলেই বেরিয়ে আসছে অন্য কথা। ‘অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’ ভোটের স্বার্থে কী কী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, নাম-পরিচয় গোপন রেখে তা জানিয়ে দিচ্ছেন পুলিশ কর্মীরাই। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশকর্মী জানালেন, শাসক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে পদক্ষেপ করার আগে চার বার ভাবতে বলা হয়েছে তাঁদের। ‘‘কী ভাবতে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, এত বছর চাকরির পরে বিলক্ষণ বুঝেছি,’’ বললেন তিনি। এ ভাবে যে সুষ্ঠু ভোট হয় না, জানেন সকলেই। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক তরুণ আইপিএসের কথায়, ‘‘বুথের পাশে মাস্তানদের দৌরাত্ম্য সামলাতে কাঁদানে গ্যাস, বন্দুক লাগে না। কুড়ি মিনিটে লাঠি মেরে সব সিধে করে দেওয়া যায়। আইপিএস হয়ে গুন্ডা দমনের শপথ নিয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে গুন্ডামি দেখতে গা জ্বলে যায়।’’

শনিবার কি তবে গুন্ডামি দমন করবেন? উত্তর আসে, ‘‘আমরা চাই মানুষ ভোট দিক। কিন্তু বোঝেন তো, বাড়ির কর্তা যা বলেন, পরিবারের সকলকে তাই শুনতে হয়!’’ কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় পুলিশেরও নেই। বর্ধমানের এক পুলিশকর্মীর আক্ষেপ, ‘‘পাল্টা কিছু করলে তো আমাদেরই শাস্তির মুখে পড়তে হবে। ফলে চোখে ঠুলি বেঁধে থাকাই ভাল।’’ অনেকেরই গায়ে বিঁধছে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। মুর্শিদাবাদে পুলিশের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর বললেন, “মানুষ আমাদের মুখের ওপর ‘চামচা-পুলিশ’, ‘তৃণ-পুলিশ’ বলছে। স্ত্রী, সন্তানরাও টিভির খবর দেখে ‘নিধিরাম সর্দার’ বলে কটাক্ষ করছে। আমাদের জন্য না আছে নিরাপত্তা, না আছে সম্মান।’’ কিন্তু শেষমেশ সম্মানরক্ষার চিন্তাকেও ছাপিয়ে উঠছে ভয়।

গার্ডেনরিচে এসআই তাপস চৌধুরী শাসক দলের গুলিতে মারা গেলেন, তাঁর পরিবার এখনও বিচার পায়নি। তার উপরে গত শনিবার কলকাতা পুরভোটে এসআই জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে ফের প্রাণের ভয় তাড়া করছে পুলিশকে। কোনও রকম ঝুঁকি আর নেবেন না, অনেকেই ঠিক করে ফেলেছিলেন সে দিনই। তার পর তাঁরা এও দেখলেন, ওই ঘটনার রিপোর্টে শাসক দলের নামও করেননি পুলিশ কমিশনার। ফলে তাঁদের এখন একটাই কথা, হিরো হতে গিয়ে জান খোয়াতে রাজি নন তাঁরা। নদিয়ার এক এএসআই বলেই দিলেন, ‘‘এই অবস্থায় কে ঝুঁকি নিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলুন?’’ সোনামুখী পুরভোটে একটি বুথে যাওয়া এক পুলিশকর্মী বলেন, “জগন্নাথ মণ্ডলের উপর গুলি চলার পরে সতর্ক হয়ে গিয়েছি। পিস্তল দূরের কথা, লাঠি উঁচিয়ে ওদের ভয় দেখানোর অধিকারও আমাদের নেই।’’

তা ছাড়া শুধু প্রাণের মায়াও তো নয়! উপরতলার নির্দেশ অগ্রাহ্য করে কিছু করলে নেমে আসতে পারে শাস্তির খাঁড়া! ঘনিষ্ঠ মহলে বহু পুলিশ কর্মীই কবুল করছেন, একদিন সাহস দেখানোর বিনিময়ে দুমদাম বদলি হতে রাজি নন তাঁরা। উত্তরবঙ্গে যে ১২টি পুরসভায় ভোট, তার ওসি-আইসিদের অনেকেই মাত্র মাস কয়েক আগে দায়িত্ব পেয়েছেন। ‘‘বহু ধরাধরি করে যে থানার দায়িত্ব মিলেছে, একটা ভোটের দিনের জন্য তা হাতছাড়া করব নাকি?’’ বললেন এক অফিসার।

ঝুঁকি নিয়ে শাস্তির মুখে পড়ার ভয় যেমন আছে, তেমনই আছে ‘কৃতজ্ঞতা’র কর্তব্যও। পছন্দসই পোস্টিংয়ের জন্য ‘রিটার্ন গিফট’ দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতিও কিছু পুলিশ অফিসারের দেখা যাচ্ছে বলে কানাঘুষো পুলিশের অন্দরেই। বিরোধীদের একাংশের অভিযোগ, পুলিশকর্মীরা শুধুই যে দায়ে পড়ে শাসক দলের সহায়তা করছেন, এমন নয়। বেশ কিছু জেলায় পুরভোটের দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীরা শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ভোটের দিনের ঘুঁটি সাজিয়েছেন। অভিযোগ, কোথায় টাকা ছড়ালে কাজ উদ্ধার হবে, কোথায় অন্য কিছু দিতে হবে, পুলিশের একাংশ সে ব্যাপারে নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন। বহিরাগতদের দিয়ে বুথ দখলের ছক-ও নাকি তৈরি হচ্ছে এমন ‘যৌথ উদ্যোগে’। সূত্রের খবর, কিছুটা ‘অনিশ্চিত’ আসনগুলিতে কয়েকটি করে ওয়ার্ড চিহ্নিত করা হয়েছে। নানা জেলায় শাসক দলের এই ‘টার্গেট’-করা ওয়ার্ডগুলি পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘স্পর্শকাতর’ ওয়ার্ডের তালিকায় রাখছে না বলে অভিযোগ। বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ দাবি করছেন, ‘‘বাম আমলে দলের উপরমহলের নেতারা বুথ দখলের ছক কষে পুলিশকে তা দিতেন। এখন থানায় থানায় পুলিশই ছক কষে তৃণমূলের নেতাদের দিচ্ছে। মমতার এই ‘কলকাতা মডেল’ই শনিবার জেলায় জেলায় দেখা যাবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement