ভোটের বছরে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিই যে তাঁর প্রশাসনের পথের কাঁটা, বুধবার বর্ধমানে শততম প্রশাসনিক বৈঠকে তা গোপন করলেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য এবং জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে নির্দেশ এল, ‘‘যাতে প্লাস হয় সে রকম কাজ করবেন, মাইনাস হয় এমন কাজ করবেন না।’’
কিন্তু এত করে বলেদেওয়ার পরেও তেমন কিছু হলে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তা স্পষ্ট, ‘‘তা
হলে আমাকে একটু দেখে নিতে হবে।’’ মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘দেখে নেওয়ার’ অর্থ কী, এ দিন বৈঠকে উপস্থিত নেতা-মন্ত্রী এবং সরকারি অফিসারদের কারওরই বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি।
বুঝিয়ে দিতে ছাড়েননি মমতাও। বৈঠক যেহেতু বর্ধমানে হচ্ছিল, সেখানকার পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবালকে যেমন ডেকে বললেন, ‘‘তোমার এখানে বালি খাদানের কারবার যেন বন্ধ হয়। কী ব্যবস্থা নিয়েছ?’’ পুলিশ সুপার উত্তরে জানান, প্রতিদিন তল্লাশি চলছে। পরক্ষণেই মুখ্যমন্ত্রীর নজরগেল আসানসোলের পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দের দিকে। জানতে চাইলেন, ‘‘অজয়, কয়লার বেআইনি কারবার চলছে না তো?’’
পুলিশ কমিশনার জানান, তাঁর এলাকায় কয়লা তোলার বেআইনি খনিগুলি পুরোপুরি বন্ধ কর
দেওয়া হয়েছে। তার সুফল পেয়েছে ইসিএল। তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘২০১০-১১ সালে ইসিএলের
রাজস্ব ছিল ৬০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। যা এখন বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা।’’ আইনি পথে কয়লা বিক্রি বেড়েছে বলেই ইসিএলের আয় বেড়েছে বলে জানান অজয়বাবু। এ কথা শুনে বর্ধমানের পুলিশ সুপারও জানান, বালি খাদানের গাড়ি থেকে তাঁরাও এক কোটি ২০ লক্ষ টাকার রাজস্ব আদায় করেছেন।
এ সব তথ্য পরিসংখ্যানে এ দিন অবশ্য বিশেষ মন ছিল না মুখ্যমন্ত্রীর। বরং যে ভাবে আইন-শ়ৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে, তাতে দলীয় নেতা-মন্ত্রী এবং পুলিশ-প্রশাসনের জন্য আচরণবিধি তৈরি করে দেওয়াতেই তিনি অনেক বেশি জোর দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘খাদান, খনি নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি বরদাস্ত করা হবে না।’’ সরকারি টাস্ক ফোর্সের উল্লেখ করে তিনি জানান, টাস্ক ফোর্সঠিক মতো কাজ না করলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হবে না। তা হলে শান্তি থাকবে। শান্তি থাকলে উন্নয়নের কাজে মন দিতে পারবে সরকার।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এত আলোচনা করলেন কেন? এক প্রবীণ মন্ত্রীর ব্যাখ্যা, ‘‘দশ মাস পর ভোট। আমাদের বিরোধী নেই। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে যে ভাবে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে প্রতিদিন কিছু না কিছু প্রকাশিত হচ্ছে, সেটা চিন্তার। মুখ্যমন্ত্রী সেই কারণেই এ নিয়ে থানার অফিসারদের পর্যন্ত সতর্ক করেছেন।’’ মুখ্যমন্ত্রী নিজেও এ দিন সংবাদমাধ্যমের প্রসঙ্গ টেনে দাবি করেন, ‘‘আগে সংবাদমাধ্যম এত সক্রিয় ছিল না। এখন পারিবারিক ঝামেলাও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হিসাবে দেখানো হচ্ছে। তবে কোনও ঘটনাই সরকার লঘু করে দেখে না। প্রয়োজনে কঠোর হতেও পিছপা নয়।’’ এই ‘কঠোরতা’র পিছনে আরও একটা কারণের কথা উল্লেখ করছেন সচিবরা। প্রায় ১০০টি বৈঠকেই ছিলেন এমন এক সচিবের কথায়, ‘‘দশ মাসের আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি যেমন থাকবে, তার উপরেই নির্বাচন কমিশন বিধানসভা ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করবে। এই পর্যায়ের শেষ প্রশাসনিক বৈঠকে সেই জন্যই এ নিয়ে পুলিশ কর্তাদের কড়া বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’
মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে বলে মত প্রশাসনিক মহলের। বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বর্ধমানের বেশ কিছু ওসি ও আইসি-দের কাছে এলাকার পরিস্থিতি জানতে চান। মাধবডিহি, কালনা, কাটোয়া, কেতুগ্রাম, রায়না, খণ্ডঘোষ, জামালপুরের মতো থানাগুলি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এর পর শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীই বলেন, ‘‘দেখলেন তো, কোন কোন থানার ওসি-আইসিদের সঙ্গে কথা বললাম? যেখানে বালি খাদান, কয়লা, মারামারি-কাটাকাটি রয়েছে, সেখানে আমার নজর।’’ গোলমাল যে হচ্ছে, তা এ দিন কার্যত মেনেই নিয়েছেন মমতা। তাঁর মতে, ‘‘কেউ কেউ টাকা করতে খনি-খাদানের বেআইনি কারবারে যুক্ত হয়। সরকার সে সব বরদাস্ত করবে না। কিছু চালাতে হলে আইনি ভাবে চালাতে হবে।’’
সরকার কত কঠোর তার উদাহরণ দিয়ে মমতার দাবি, ‘‘চার বছরে নিজের দলেরই প্রায় সাত হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করেছি। এ রাজ্যে আর কোনও সরকার তার দলের প্রতি এত নিষ্ঠুর ছিল কি?’’