দেউচা-পাঁচামি খনি এলাকা। —ফাইল চিত্র
থালা-বাসনে ঠোকাঠুকি হয়। ভাইয়ে-ভাইয়েও হয়। ভাগীদার ছ’টি রাজ্যের মধ্যেও হচ্ছিল, তলে তলে। সেটা এড়াতে বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের দেউচা-পাঁচামি খনি থেকে কয়লা তোলার প্রকল্পটি একাই রূপায়ণ করতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পড়শি পাঁচ রাজ্যের সঙ্গে আদৌ গাঁটছড়া না-বেঁধে গোড়াতেই বড় ঝামেলার পথ বন্ধ করে দিতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মাসখানেক আগে এই দাবি জানিয়ে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী পীযূষ গয়ালকে চিঠি দিয়েছিলেন রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। আর বুধবার দিল্লিতে এই নিয়ে গয়ালের সঙ্গে মমতার কথা হয় সরাসরি। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, সমস্যাটি সম্পর্কে তিনি অবহিত বলে মমতাকে জানান কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য কার্যত সমর্থন করে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন গয়াল।
রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতরের খবর, ওই খনি প্রকল্পের শুরুর দিকে একাধিক রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে ওই কয়লা তোলার কাজ আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকারই। সমস্যাটা এখন কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রীকেও ভাবাচ্ছে। তাই দেউচায় রাজ্যের একলা চলার দাবি মেনে নিতে কেন্দ্রের আপত্তি থাকার কথা নয়। এই বিষয়ে রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রীর বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। জবাব মেলেনি এসএমএসেরও। মুখ খুলতে চাননি বিদ্যুৎসচিব গোপালকৃষ্ণ।
গত বছর দেউচা-পাচামি খনিটি পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়ার সময় কয়লা মন্ত্রক জানিয়েছিল, সেখান থেকে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু আর কর্নাটকও কয়লা পাবে। তবে খনিটি যে-হেতু পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে, তাই মোট কয়লা উৎপাদনের ২৮ শতাংশ পাবে বাংলা। বিহারের জন্য বরাদ্দ থাকবে ২৩ শতাংশ। অন্য চার রাজ্য তাদের প্রাপ্য অনুযায়ী বাকি কয়লার ভাগ পাবে।
কেন্দ্রের এই সূত্র মেনে প্রায় দেড় বছর ধরে নিজেদের মধ্যে বিস্তর আলোচনার পরে গত অক্টোবরে কয়লার ভাগীদার ছয় রাজ্য মিলে একটি সংস্থা তৈরি করে। নাম দেওয়া হয় ‘বেঙ্গল বীরভূম কোলফিল্ডস লিমিটেড’। চেয়ারম্যান হন জাতীয় খনিজ উন্নয়ন নিগমের প্রাক্তন চেয়ারম্যান রানা সোম। সংস্থা তৈরির পরে মমতা ফেসবুক বার্তায় লেখেন, ‘নতুন একটি সংস্থার জন্ম হল। এরা কয়লা তোলার কাজ করবে। কাজ শুরু হলে বীরভূমে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বদলে যাবে বীরভূমের আর্থ-সামাজিক চেহারা।’
তার মাস দুয়েকের মধ্যেই নিজেদের অবস্থান বদলে ফেলেছে মমতার সরকার। সম্প্রতি বীরভূমে এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানান, দেউচা-পাঁচামি খনি প্রকল্পের কাজ রাজ্য একাই করতে চায়। কিন্তু কেন?
কেন্দ্রের কাছে মূলত দু’টি যুক্তি দেখিয়েছে রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতর। তাদের দাবি: l নতুন সংস্থা তৈরি করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছিল। কারণ, এক-একটি রাজ্যের চাহিদা এক-এক রকম। তবু অনেক চেষ্টায় অংশীদার রাজ্যগুলিকে রাজি করিয়ে সংস্থা তৈরির চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু নতুন সংস্থার পরিচালন পর্ষদের প্রথম দু’টি বৈঠকের পরেও ছোটখাটো বিষয়েও মতবিরোধ এড়ানো যাচ্ছে না। l সংস্থা চালাতে টাকার দরকার। প্রয়োজনের সময় কোনও একটি রাজ্য যদি আর্থিক টানাটানির কারণ দেখিয়ে মূলধন দিতে না-পারে, তা হলে পুরো কাজ আটকে যেতে পারে। সে-ক্ষেত্রে অর্থের জোগান দিতে অপারগ রাজ্যের উদাহরণ টেনে টাকা ঢালার কাজে ঢিলেমি করতে পারে অন্য রাজ্যও। এই দু’টি কারণে ভবিষ্যতে সংস্থা চালাতে বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হতে পারে। তাই একাই প্রকল্প গড়তে চাইছে পশ্চিমবঙ্গ, বলছেন বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা।
মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী দেউচা ব্লকে প্রায় ২১০ কোটি ২০ লক্ষ টন কয়লা মজুত আছে। তবে এই কয়লা তোলার কাজ বেশ জটিল। কেন্দ্রের সমীক্ষা বলছে, দেউচা ব্লকে কয়লা রয়েছে ভূগর্ভের ১০০-১৫০ মিটার নীচে। তার মাঝখানের স্তরে রয়েছে কালো পাথর। সেই পাথর কেটে তবেই খনিতে পৌঁছনো যাবে। ভূগর্ভে এমন পাথর কাটার প্রযুক্তি দেশের কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থারই নেই। তাই কয়লা তোলার দায়িত্ব দিতে হবে কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে। তাদের সঙ্গে থাকবে পশ্চিমবঙ্গ খনিজ উন্নয়ন নিগম।
রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতরের এক কর্তা জানান, দেউচা-পাচামি খনির কোথায় কতটা কয়লা কী ভাবে আছে, তার মানচিত্র তৈরি করে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রকে চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সেই মানচিত্র-সহ তথ্যভাণ্ডার না-থাকলে আন্তর্জাতিক স্তরে দরপত্র ডাকার কাজটাও করা যাবে না। ওই মানচিত্র তৈরির কাজটি করবে রাঁচির রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘সেন্ট্রাল মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউট’ বা সিএমপিডিআই। রাজ্যের একলা চলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লি কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই দেখার।
পশ্চিমবঙ্গের আর্জি মানা হলে ওই খনির তোলা কয়লা বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে কী ভাবে ভাগাভাগি হবে, সেটা ঠিক করতে হবে কেন্দ্রকেই।