বিনিয়োগের বিরাট দাবি

শিল্পকে বরাভয় দিয়ে কেন্দ্রকে আক্রমণ

এক দিকে রাজ্যে লগ্নির পরিবেশ নিয়ে শিল্পপতিদের বরাভয় জোগানো! অন্য দিকে, শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়িয়ে কালো টাকা উদ্ধারের নামে কেন্দ্রীয় সরকারের হয়রানির পরোক্ষ প্রতিবাদ। ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট ২০১৬’-র শেষ দিনে এমনই ‘শিল্পবন্ধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখল মিলনমেলা প্রাঙ্গণ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৭
Share:

‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট ২০১৬’-র শেষ দিনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। ছবি: সুমন বল্লভ।

এক দিকে রাজ্যে লগ্নির পরিবেশ নিয়ে শিল্পপতিদের বরাভয় জোগানো! অন্য দিকে, শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়িয়ে কালো টাকা উদ্ধারের নামে কেন্দ্রীয় সরকারের হয়রানির পরোক্ষ প্রতিবাদ। ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট ২০১৬’-র শেষ দিনে এমনই ‘শিল্পবন্ধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখল মিলনমেলা প্রাঙ্গণ। বিধানসভা ভোটের মুখে শিল্পায়ন প্রসঙ্গে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে মরিয়া মুখ্যমন্ত্রী ‘হয়রানি মুক্ত’ বাংলায় লগ্নির জন্য শিল্পমহলের কাছে আহ্বান জানিয়ে বললেন, ‘‘আমরা শিল্প-কর্তাদের হয়রান করতে চাই না। এই শিল্প সম্মেলন থেকে আমাদের বার্তা, আসুন শিল্পকে সাহায্য করি।’’

Advertisement

২০১৪ লোকসভা ভোটের আগে কালো টাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। বলেছিলেন, সব কালো টাকা উদ্ধার করতে পারলে দেশের প্রতিটি নাগরিককে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া যাবে। কিন্তু গত দেড় বছরে কালো টাকা উদ্ধার হয়েছে মাত্র আড়াই হাজার কোটি! শিল্পমহলের অন্দরে অভিযোগ, সরকারের মুখ রাখতে কালো টাকা উদ্ধারের নামে জুলুম শুরু করেছে আয়কর বিভাগ। যে কারণে ক্রমে ক্ষোভ জমছে শিল্পপতিদের মনে।

তৃণমূল শিবিরের অন্দরের খবর, এই পরিস্থিতিতে শিল্পপতিদের মন জিততে শিল্প সম্মেলনের মঞ্চ থেকে কালো টাকার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘কালো টাকা উদ্ধার আর তার নামে হয়রানি, এক নয়। কালো টাকা উদ্ধার করতে পারলে কর। সেই টাকা উন্নয়নের কাজে খরচ করতে বল।’’ শুধু তা-ই নয়, কেন্দ্রের একাধিক নীতির কারণেও যে শিল্পপতিরা সমস্যায় পড়েন, সেটা এ দিন সুকৌশলে তুলে ধরেন মমতা। তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘ক্ষমতায় আছি বলে জোর দেখাতে পারি না। চেয়ারে থেকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মেটাতে বুলডোজার চালানো যায় না।’’

Advertisement

বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্য বক্তব্য, এই একই অভিযোগ এ রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধেও খাটে। তৃণমূলের ছোট-বড় নেতাদের মদতে পুষ্ট সিন্ডিকেট রাজ এবং তোলাবাজির দাপটে রাজ্যে যেটুকু শিল্প রয়েছে, তা-ও উঠে যাওয়ার জোগাড়! সম্প্রতি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর সভায় দেশের মুখ্য অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম বলেছিলেন, ‘ঋণ ভার রাজ্যের মূল সমস্যা নয়। বরং পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা করা সহজ নয়।’’ ওই অনুষ্ঠানেই অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও তুলেছিলেন সিন্ডিকেট রাজের নামে তোলাবাজির প্রসঙ্গ।

নবান্নে বসে সিন্ডিকেট রাজ নিয়ে রাশি রাশি অভিযোগ শোনা মমতা নিজেও এই বাস্তবটা জানেন। ভোটের মুখে দলের ভাবমূর্তি ফেরাতে তাই আসরে নামতে হয়েছে তাঁকে। গত সপ্তাহেই শালবনিতে জিন্দলদের সিমেন্ট কারখানার শিলান্যাস অনুষ্ঠানে দলীয় সাংসদ, বিধায়ক ও স্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে মমতার স্পষ্ট বার্তা ছিল, ‘‘আমায় কন্ট্র্যাক্ট দিতে হবে, ওঁদের কন্ট্র্যাক্ট দিন, এ সব যেন না হয়। ওঁদের কাজ করতে দিন। ওঁদের অভ্যন্তরীণ কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না।’’ এ দিন নিজের শিল্পবন্ধু চেহারা তুলে ধরতে শালবনির থেকে এক ধাপ এগিয়ে প্রশাসক হিসেবে আরও কড়া হওয়ার বার্তা দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘প্রশাসনে থাকলে কখনও সখনও ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ হতে হয়। গুন্ডা, সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতী— কাউকেই আমরা অ্যালাও করব না।’’ মমতার এই মন্তব্য আসলে শিল্পকর্তাদের আস্থা জোগানোর চেষ্টা বলেই মনে করছে শিল্পমহলের একাংশ।

তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে আর একটা বড় অভিযোগ তার শিল্প-বিরোধী অবস্থান ও ভ্রান্ত জমিনীতি। মমতা বিরোধী নেত্রী থাকার সময় সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানার বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলনের জেরেই এ রাজ্য থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয় টাটারা। একই ভাবে নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাবের বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন ও তার জেরে সেখানে পুলিসের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুর পরে রাজ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়াই কার্যত থমকে যায়। বন্ধ হয়ে যায় রাজ্যে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। পালাবদলের পরেও যা বদলায়নি। মমতা অবশ্য এ দিন দাবি করেন, তিনি কখনওই শিল্পে বাধার সৃষ্টি করেননি। এমনকী বিরোধী থাকার সময়েও নয়। তাঁর কথায়, ‘‘এটা আমাদের চরিত্র নয়।’’

সেই দাবি মানতে নারাজ শিল্পমহলের আরও বক্তব্য, শিল্পের জন্য এক ছটাক জমি না নেওয়ার নীতিই শিল্পায়নের পথে বড় অন্তরায়। তৃণমূল সরকারের বক্তব্য, সরকারি ল্যান্ড ব্যাঙ্কে যথেষ্ট জমি রয়েছে। সেখানেই শিল্প করা সম্ভব। অন্য দিকে শিল্পপতিদের বক্তব্য, ল্যান্ড ব্যাঙ্কে একলপ্তে জমি নেই। ফলে বড় শিল্প করা অসম্ভব। সঙ্গে রয়েছে পরিকাঠামোর সমস্যাও। জমি সমস্যা আর সিন্ডিকেট রাজের দাপট— এই দুইয়ে মিলে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের এখন নাভিশ্বাস দশা।

প্রশাসক হিসেবে গত প্রায় পাঁচ বছরে লগ্নির এই বেহাল চেহারাটা বিলক্ষণ টের পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই

গত দু’তিন বছর ধরে শিল্পবন্ধু হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চেয়ে বেশ ক’বার বার্তা দিয়েছেন। এ দিনও হয়রানি মুক্ত পশ্চিমবঙ্গে লগ্নি চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ‘‘সব কিছু ‘স্মুথ’ চলছে। পশ্চিমবঙ্গ পুরো মাত্রায় শান্তিপূর্ণ জায়গা।’’ যদিও ওই মঞ্চ থেকেই তা উড়িয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী। এবং তাঁর আঙুল মমতার সরকারের জমি নীতির দিকেই! গডকড়ীর কথায়, ‘‘জমির সমস্যার জন্যই জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ মাঝে মধ্যেই বাধা পাচ্ছে।’’

এ দিন অবশ্য এ সব সমালোচনায় কান দেননি মমতা। বরং রাজ্যে ‘লগ্নির বন্যা’য় উচ্ছ্বসিত হয়ে আগামী বছরের শিল্প সম্মেলনের দিনক্ষণও আগাম জানিয়ে দিয়েছেন! ২০১৭ সালের ২০ ও ২১ জানুয়ারি ফের বসবে ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’-এর আসর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement