‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট ২০১৬’-র মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। হাজির মুকেশ অম্বানী-সহ এক ঝাঁক শিল্পপতি। শুক্রবার মিলনমেলা প্রাঙ্গণে সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।
তারকার সমাবেশ।
শুক্রবার মিলনমেলা প্রাঙ্গণে ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট ২০১৬’-এর প্রথম দিনে মঞ্চে হাজির দেশের প্রথম সারির এক ঝাঁক শিল্পপতি। রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর মুকেশ অম্বানী, জিন্দল গোষ্ঠীর সজ্জন জিন্দল, ভারতী এন্টারপ্রাইজের রাকেশ ভারতী মিত্তল, হিরানন্দানি গোষ্ঠীর নিরঞ্জন হিরানন্দানি, জি গোষ্ঠীর সুভাষ চন্দ্র, আইটিসি কর্তা যোগী দেবেশ্বর, প্রাক্তন ইনফোসিস কর্তা মোহনদাস পাই, সঞ্জীব গোয়েন্কা, টাটা স্টিলের টি ভি নরেন্দ্রন।
কথার ফুলঝুরি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর্জি, ‘‘দয়া করে এখানে বিনিয়োগ করুন। যা সাহায্য চান দেব। আমাদের সরকার আপনাদের কর্মী হিসেবে কাজ করবে। আপনারা নিয়োগকর্তা, আমরা কর্মী।’’ মুকেশ অম্বানী বললেন, ‘‘গত তিন বছরে আমরা এখানে ৫০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। এ রাজ্যে বিনিয়োগ করতে আমি সুপারিশ করছি।’’ সেই সুরে সুর মিলিয়ে নিরঞ্জন হিরানন্দানির মন্তব্য, ‘‘মুকেশ অম্বানীর মতো আমিও এ রাজ্যে বিনিয়োগ করার সুপারিশ করছি। আগে এখানে বিনিয়োগকারীরা আসতে ভয় পেতেন। এখন এ রাজ্যেই পাওয়া যায় সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব।’’ সজ্জন জিন্দলেরও দাবি, বিনিয়োগ করার সঠিক জায়গা পশ্চিমবঙ্গ। এ রাজ্যে ব্যবসা করার পক্ষে সওয়াল করেন সদ্য হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের কর্তৃত্বভার হাতে পাওয়া পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ও।
দিনের শেষে প্রশ্ন।
এ বারের শিল্প সম্মেলন থেকে বাংলার প্রাপ্তি কতটা? প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে সেই সংক্রান্ত ঘোষণা হয়নি। মমতা শিল্পপতিদের বলেছেন, ‘‘আজ আপনারা বলবেন, আমরা শুনব। কাল বাকি বিনিয়োগের কথা বলব।’’ কিন্তু রাজ্যের সামগ্রিক শিল্পচিত্র, ভাবমূর্তি এবং অতীত অভিজ্ঞতার নিরিখে শিল্পমহলের একাংশের ধারণা— আজ শনিবার সম্মেলনের শেষ দিনে সরকারের দাবিদাওয়া যা-ই হোক, বাস্তবে উৎসাহিত হওয়ার মতো লগ্নি ভাঁড়ারে আসবে এমন সম্ভাবনা কম।
তবে দিনের শেষে এটাও সত্যি যে, তৃণমূল সরকারের জমানায় এই শিল্প সম্মেলনই সবচেয়ে নজরকাড়া। সম্মেলনস্থল জুড়ে পেশাদারিত্বের ছাপ। শিল্পপতি থেকে শুরু করে শিল্প-কর্তাদের উপস্থিতিও আগের থেকে ভাল। অম্বানীরা ছাড়াও ছিলেন সিআইআই প্রেসিডেন্ট সুমিত মজুমদার, অ্যাসোচ্যামের প্রেসিডেন্ট সুনীল কানোরিয়া, ফিকি-কর্তা হর্ষ নেওটিয়া। তবে এক ঝাঁক রাজনীতিকের উপস্থিতি অবশ্যই ভাল বার্তা দেয় না শিল্প সম্মেলন সম্পর্কে। এ দিনের মঞ্চে চার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছাড়াও ছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী, ব্রিটেন, জাপান, বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষস্তরের প্রতিনিধি। মহারাষ্ট্র হোক বা গুজরাত, শিল্পে এগিয়ে রয়েছে এমন কোনও রাজ্যের শিল্প সম্মেলনে এত রাজনীতিকের দেখা মেলে না। শিল্পই সেখানে মুখ্য।
এ দিনের অনুষ্ঠানের সুর অবশ্য ছিল ইতিবাচক। রাজ্যকে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কেন পশ্চিমবঙ্গ শিল্পের গন্তব্য? কারণ দায়বদ্ধতার উপর নির্ভর করে বিশ্বাসযোগ্যতা। আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতাই আমাদের দায়বদ্ধতা।’’ মুখ্যমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় শরিক হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন চার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীই। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এ দিন তাঁর বক্তৃতায় আগাগোড়া দুষেছেন আগের বামফ্রন্ট সরকারকে। তাদের ভুল থেকে ‘শিক্ষা’ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ যা যা শিল্পমুখী নীতি নেবে, আমরা পাশে থাকব। সঠিক নীতি নিলে এ রাজ্য আবার হৃতগৌরব ফিরে পাবে।’’
শিল্পমহলের একাংশ বলছে, প্রশ্ন তো নীতি নিয়েই। তাঁদের বক্তব্য, এ দিনের অনুষ্ঠানে যে সব শিল্পপতি রাজ্য সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলেছেন, তাঁদের সকলেরই এ রাজ্যে লগ্নি রয়েছে। ফলে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলাটাই দস্তুর। কিন্তু নতুন লগ্নি নিয়ে তাঁদের কেউ এ দিন অন্তত ঝেড়ে কাশেননি। কারণ, তৃণমূল সরকারের শিল্পনীতি ঘিরেই ধোঁয়াশা। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না-করার অবস্থানে অনড় মুখ্যমন্ত্রী। ছোট জোতের রাজ্যে অসংখ্য জমি মালিকের সঙ্গে আলোচনা করে জমি কেনা যে শিল্পসংস্থার পক্ষে কার্যত অসম্ভব, সেটাই বুঝতে চায় না শাসক দল। শহর বা গ্রামে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন তুলে দিতেও নারাজ রাজ্য সরকার। তাদের বক্তব্য, সরকারের কাছে যা জমি রয়েছে সেখানেই শিল্প গড়ুন শিল্পপতিরা। বস্তুত মমতা এ দিনও বলেছেন, ‘‘ল্যান্ড ব্যাঙ্কে ৫০০ একর জমি রয়েছে। পরিকাঠামো তৈরি। সেখানে লগ্নি করুন। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি দফতরের হাতে এক লক্ষ একরেরও বেশি জমি রয়েছে।’’
শিল্পমহলের বক্তব্য, ল্যান্ড ব্যাঙ্কে এক লপ্তে বড় জমি মেলা দুষ্কর। ফলে ভারী শিল্প গড়া অসম্ভব। তাই গত সাড়ে চার বছরে কার্যত থমকে রয়েছে শিল্পে রাজ্যের অগ্রগতি। তার পরেও যাঁরা সাহসভরে শিল্প করতে এসেছেন, তাঁরা শিকার হয়েছেন শাসক দলের নেতাদের তোলাবাজি এবং সিন্ডিকেট রাজের। মমতা অবশ্য এ দিন শিল্পপতিদের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ‘‘যদি সমস্যা হয়, আমার কাছে আসুন। এক সেকেন্ডে সমাধান করে দেব।’’ কিন্তু তাতে কত জন শিল্পপতি আস্থা রাখবেন, তা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই।
ফলে এ দিন শিল্পপতিদের মন্তব্যকে সৌজন্য হিসেবেই দেখছে শিল্পমহলের বড় অংশ। মুকেশের উদাহরণ টেনে তারা বলছে, চলতি বছরেই চালু হতে চলা টেলিকম ব্যবসার পরিকল্পনা বিশদে জানালেও এ রাজ্যে স্থগিত খুচরো বিপণন প্রকল্প নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি তিনি। হিরানন্দানি গোষ্ঠী গত বছরের শিল্প সম্মেলনে গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে ৭০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ পরিকল্পনা জানালেও তার কাজ এখনও শুরু হয়নি।
এমনকী পূর্ণেন্দুবাবু পেট্রোলিয়াম শোধনাগার করার পরিকল্পনার কথা জানালেও তাতে কত টাকা বিনিয়োগ হবে, তা বলতে চাননি। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র কার্যত তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নেন যে, শোধনাগার হলে ২০ হাজার কোটি টাকা পুঁজি লাগবে।
বস্তুত শিল্প সম্মেলনের প্রথম দিনে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে সামান্যই। সিঙ্গুরে জাপানের কাওয়াসাকি রিকুসু ট্রান্সপোর্টেশন তৈরি করবে সৌরবিদ্যুৎ চালিত সব্জি ও ফলের গুদামঘর। পাইলট প্রকল্প হিসেবে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে রাজি হয়েছে তারা।
গত বছরের শিল্প সম্মেলনে ২ লক্ষ ৪৩ হাজার কোটি টাকার শিল্প প্রস্তাব এসেছে বলে দাবি রাজ্য সরকারের। যদিও সরকারি নথিই বলছে, গত পাঁচ বছরে রাজ্যে বাস্তবায়িত হওয়া শিল্পের পরিমাণ ৬৮৭১ কোটি। অর্থাৎ বছরে মাত্র ১৩৭৪ কোটি। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন বলেন, ‘‘গত শিল্প সম্মেলনে আসা লগ্নি প্রস্তাবের মধ্যে ৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকার কাজ শুরু হয়েছে। বাকিটার প্রক্রিয়া চলছে।’’
আজ রাজ্যের ঝুলিতে কত লগ্নি-প্রস্তাব আসে সেটাই দেখার।