তৃণমূলেরই অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষক সংগঠনের প্রথম রাজ্য সম্মেলন চলছিল। মৌলালি যুবকেন্দ্র রবিবার সকালে তখন ভিড়েঠাসা। চলছে রাজ্য সরকারের নানা কীর্তির বর্ণনা। এরই মধ্যে বক্তার বক্তৃতা থামিয়ে দর্শকাসন থেকে এক শিক্ষক রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তাঁর সমর্থনে অনেক শিক্ষক হাততালি দিলেন। যাঁরা সরব হলেন না, তাঁরা সায় দিয়ে ঘাড় নাড়লেন। তাঁর বক্তব্যের বিরোধিতা করলেন না কোনও শিক্ষক।
উদ্যোক্তারা অবশ্য সভামঞ্চ থেকে মাইক্রোফোনে ওই শিক্ষককে থামতে বলছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদী নাছোড়বান্দা! এর পরে মঞ্চের নেতৃত্বদের জোরাজুরিতে নিজের আসনে বসতে বাধ্য হলেন ওই শিক্ষক! তাঁকে কার্যত বসিয়ে দেওয়া হলেও এই ঘটনাতেই স্পষ্ট হয়ে গেল, সংখ্যালঘু মন এখন আর শাসক দলের একচেটিয়া অধিকারে নেই! সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মুখের কথা এবং কাজের ফারাক নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বস্তুত, প্রশ্ন ওঠার ইঙ্গিত আগেও কয়েকটি অবসরে মিলেছে। কোনও সংখ্যালঘু সংগঠন, কখনও ইমামদের কেউ কেউ সরব হয়েছেন। কিন্তু এ বার যে ভাবে তৃণমূলের সংগঠনের ভিতর থেকেই বিরুদ্ধ স্বর উঠে এল, বিধানসভা ভোটের বছরখানেক আগে তা নিঃসন্দেহে তৃণমূলের জন্য চিন্তার কারণ। প্রসঙ্গত, রাজ্যের মাদ্রাসা শিক্ষা ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী স্বয়ং মমতাই।
সম্মেলনে এ দিন উপস্থিত ছিলেন হাজারখানেক শিক্ষক। আয়োজক ‘পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল আন-এইডেড মাদ্রাসা শিক্ষক অ্যাসোসিয়েশন’। সভা চলাকালীন পিছনের সারিতে বসে-থাকা এক শিক্ষক হঠাৎ নিজের আসন ছেড়ে বলতে থাকেন, ‘‘আমি এক জন শিক্ষিত যুবক। মাদ্রাসার অনুমোদন মিললেও বেতন পাচ্ছি না। আমাদের আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? আর কয়েক মাস পরেই বিধানসভার ভোট। ভোট মিটলেই যাবতীয় প্রতিশ্রুতি কি ফুরিয়ে যাবে?’’ মঞ্চে উপস্থিত তৃণমূল বিধায়ক নুরুজ্জামান, তৃণমূল কোর কমিটির সদস্য ওয়াইয়েজুল হক-সহ শাসক দলের শিক্ষক প্রতিনিধিরা তাঁকে থামতে বলেন। কিন্তু ওই শিক্ষক মঞ্চে উপস্থিত প্রতিনিধিদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলতে থাকেন, ‘‘অনেক আশা নিয়ে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছি। কিন্তু বেতন পাচ্ছি না! বাম আমলে সংখ্যালঘু বঞ্চনার হাল কি তৃণমূল আমলেও বজায় থাকবে?’’ তৃণমূলের ওই শিক্ষক সংগঠনের তরফেই সম্প্রতি প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদ্রাসার শিক্ষকদের জন্য ঢালাও প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছিল। মৌলালি যুবকেন্দ্রেও যে সেই একই আশ্বাস বাণী দেওয়া হচ্ছে, তার উল্লেখ করে ওই শিক্ষক বলে চলেন, ‘‘আমার বক্তব্য, এই সরকারের আমলে আমাদের সমস্যার সমাধান কি হবে? না বিধানসভা ভোটের পরে সব প্রতিশ্রুতি ফুরিয়ে যাবে?’’
ওই শিক্ষকের ক্ষোভ সামাল দিতে মঞ্চে উপস্থিত তৃণমূল বিধায়ক নুরুজ্জামান বলেন, ‘‘শিক্ষকদের আশাহত হলে চলবে না। অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদ্রাসার সমস্ত শিক্ষকেরা যাতে বেতন পান, সেই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বিস্তারিত জানাব।’’ সম্মেলনের আয়োজক, মাদ্রাসা শিক্ষকদের তৃণমূল-অনুমোদিত সংগঠনের সম্পাদক আব্দুল ওয়াহাব মোল্লা পরে জানান, জিয়াউর রহমান নামে ওই শিক্ষক পূর্ব পিয়ালী সিদ্দিকীয়া কাদরিয়া মোজাদ্দিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করেও বেতন না পেয়ে হতাশ হয়ে আক্ষেপ করেছেন। ওয়াহাবের কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকায় প্রত্যেক অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদ্রাসার মাত্র তিন জন শিক্ষক বেতন পান। অথচ বাকি ৭ জন শিক্ষক বেতন থেকে বঞ্চিত। অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদ্রাসায় মিড ডে মিলও চালু করা হয়নি। মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের অনুদান মিলছে না। এই সমস্ত নানা দাবি নিয়ে অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হচ্ছি।’’
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য বুঝতে পারছেন, এ দিনের ঘটনা এক জনকে নিয়ে ঘটলেও বিষয়টি শুধু এক জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গালভরা প্রতিশ্রুতি, ‘সব কাজ হয়ে গিয়েছে’র দাবি এবং বাস্তবের ছবির মধ্যে ফারাক যত ধরা পড়ছে, ততই জটিলতা বাড়ছে। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউ এ দিনের ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তবে একান্ত আলোচনায় দলের এক রাজ্য নেতার মন্তব্য, ‘‘সংখ্যালঘুদের ক্ষোভ এখনও সংগঠিত ভাবে ভোটে বা রাস্তায় আছড়ে পড়েনি ঠিকই। কিন্তু এ বারের পুরভোটেই আমাদের বিরাট সাফল্যের মধ্যেও সংখ্যালঘু ভোটে কিছুটা চিড় ধরা পড়েছে। ক্ষোভ প্রশমনে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ না হলে বিধানসভা ভোটের সময় সমস্যা হতে পারে।’’ উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার পরেই রাজ্যে অনুমোদনহীন ১০ হাজার মাদ্রাসাকে অনুমোদনের কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এখনও পর্যন্ত ২৩৪টি মাদ্রাসাকে অনুমোদন দিয়েছে রাজ্য। গত চার বছরে মাদ্রাসার অনুমোদনের জন্য প্রায় আড়াই হাজার দরখাস্ত জমা পড়েছে বলে সরকারি সূত্রের খবর।
বিরোধীরা স্বাভাবিক ভাবেই এ দিনের ঘটনাকে হাতিয়ার করে মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্রতিশ্রুতির বন্যা’র বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘সংখ্যালঘুরা ধীরে হলেও বুঝতে পারছেন, তাঁদের ভুল বোঝানো হয়েছে। তাঁদের মোহভঙ্গ হচ্ছে। কিন্তু এত দিন সমালোচনা করলে বামপন্থী বা সাধারণ মানুষের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা হতো। এখন দেখা যাচ্ছে, নিজেদের ঘরের লোকের কথাও শাসক দলের কাছে অপ্রিয় লাগছে!’’ প্রদেশ কংগ্রেসের সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান খালেদ এবাদুল্লার দাবি, শুধু মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতনের সমস্যাই নয়, বর্তমান সরকারের জমানায় পুলিশ-সহ কয়েকটি সরকারি ক্ষেত্রে সরকারি নিয়োগের হাল খুবই খারাপ। এবাদুল্লার মন্তব্য, ‘‘বামফ্রন্ট সরকার সংখ্যালঘুদের অনেকটাই ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করেছিল। এই মুখ্যমন্ত্রী ৯৯% কাজ করে দিয়েছি, মুখে বলেছেন। আসলে প্রতিশ্রুত ১০ হাজারের মধ্যে ক’টা মাদ্রাসার অনুমোদন দিয়েছেন, সংখ্যাটা দেখলেই বোঝা যাবে কী করেছেন। এই পথে চললে ওঁকে কিন্তু সংখ্যালঘুরা ৩৪ বছর সময় দেবেন না!’’ বিজেপি-র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যেরও
কটাক্ষ, ‘‘বোঝা যাচ্ছে, সংখ্যালঘু উন্নয়নের স্লোগান আসলে তৃণমূলের বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার মাত্র! সমাজের আরও অন্যান্য অংশের মানুষের মতো সংখ্যালঘুরাও তৃণমূলের স্বরূপ ধরে ফেলেছেন!’’