Madhyamik Examination

শিয়রে বড় পরীক্ষা, শেখার বাইরে বহু

স্মার্টফোন নেই। ইন্টারনেট সংযোগও অমিল। কী ভাবে চলছে ই-পড়াশোনাকরোনা-কালে এই সব প্রতিকূলতার সঙ্গেই প্রতি মুহূর্তে যুঝছে আগামী বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২০ ০৪:৩৬
Share:

বার্নপুরের শান্তিনগর বিদ্যামন্দিরের শিক্ষিকাদের ক্লাস। ছবি: পাপন চৌধুরী

স্কুল বন্ধ। টিউশনও বহু জায়গায় হচ্ছে না। কারও স্মার্টফোন নেই, তো কোথাও ইন্টারনেটের টাওয়ার পেতে ইতিউতি ছুটে বেড়াতে হয়।

Advertisement

করোনা-কালে এই সব প্রতিকূলতার সঙ্গেই প্রতি মুহূর্তে যুঝছে আগামী বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক— সকলেরই প্রশ্ন, সিলেবাসটা শেষ হবে কী করে!

সেই মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ। সংক্রমণের যা পরিস্থিতি, তাতে সেপ্টেম্বরেও স্কুল খুলবে কি না সংশয়ে শিক্ষামহল। অক্টোবরে পুজো। নিয়মমতো নভেম্বর বা ডিসেম্বরে টেস্ট হয়। ফলে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়াদের টানা দশ মাসের প্রস্তুতির পুরোটাই ঘা খাচ্ছে। অনলাইন ক্লাস, পোর্টালের মাধ্যমে পড়াশোনা, টেলিভিশনে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর আলোচনা এবং সর্বশেষ টোল-ফ্রি নম্বরে ফোন করে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া— রাজ্য শিক্ষা দফতর চেষ্টার কসুর করছে না। কিন্তু ষোলো আনা ফলপ্রসূ হচ্ছে না কোনওটা। বহু পড়ুয়াই এই সব আয়োজনের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

Advertisement

কোচবিহারের মাথাভাঙার তপন বর্মণ, নবম শ্রেণির ছাত্র। হতদরিদ্র কৃষিজীবী পরিবারে দু’বেলা ভাত জোগাড়টাই যেখানে যুদ্ধ, সেখানে স্মার্টফোন স্বপ্ন। খাতা, পেন নিয়ে তপন প্রায়ই বন্ধুদের এর-ওর বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। অনলাইন ক্লাসের পড়া লিখে আনে। ফুচকা বিক্রি করে করে সংসার ও পড়ার খরচ চালিয়ে মাধ্যমিকে নজরকাড়া ফল করা বার্নপুর গাঁধী স্কুলের ছাত্র শক্তি সিংহও বলে, ‘‘প্রতি মাসে অনলাইনে পড়ার খরচ হবে বাড়তি ৪০০ টাকা। জোগাড় করা খুবই কষ্টের।’’

পাহাড়-জঙ্গলঘেরা প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র পড়ুয়াদের অবস্থা আরও সঙ্গিন। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি এসসি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সোমনাথ দ্বিবেদী জানালেন, জ়ুম অ্যাপে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার পড়ুয়ারা সে সুযোগে বঞ্চিত। পশ্চিম মেদিনীপুরে গোয়ালতোড়ের ডুমুরডিহা গ্রামের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সমীরণ লোহার জানাল, নেটওয়ার্কের খোঁজে ঘর ছেড়ে ফোন আর খাতাবই নিয়ে মাঠে পড়তে যায়। শালবনির জয়পুর এলাকার দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা শ্যামল মাহাতো বলেন, ‘‘মেয়ে অনলাইনে পড়বে বলে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে বড় ফোন কিনে দিয়েছি। নেট রিচার্জ করিয়েও মেয়ে বলছে টাওয়ার নেই।’’ অগত্যা মিড ডে মিলের চাল-আলুর সঙ্গে অভিভাবকদের হাতে পড়ুয়াদের হোম টাস্ক দিচ্ছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বহু বাড়িতে পড়াশোনার চল না থাকায় দেখিয়ে দেওয়ার কেউ থাকছে না। ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল কিংবা উত্তরে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, শিলিগুড়ি, বালুরঘাটের সীমান্তবর্তী এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কের শ্যাডো জ়োনে দূরভাষই বা কী ভাবে মুশকিল আসান হবে— প্রশ্ন থাকছেই।

আগামী বছর মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস কমানোর ঘোষণাও এখনও পর্যন্ত নেই, যেমনটা সিবিএসই দশম শ্রেণির ক্ষেত্রে করেছে। ফলে, অনলাইন ক্লাসে নিয়মরক্ষার সিলেবাস শেষ হলেও পড়া বোঝার বাইরে থাকবে অনেকেই। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিমাদ্রি চৌধুরী মানছেন, “সিলেবাস হয়তো শেষ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু কত জন সেই অনলাইন পঠনপাঠনের সুবিধা পেল, সে প্রশ্ন থেকেই যাবে।”

কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের মতো শহুরে স্কুলগুলিতে অনলাইন ক্লাস চলছে পুরোদমেই। প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন বিশ্বাস বলছেন, “কেউ মোবাইলের অভাবে ক্লাস করতে পারছে না বলে জানা নেই।” তবে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে বরাবর উজ্জ্বল পূর্ব মেদিনীপুরে শিক্ষা দফতরের পরিসংখ্যানই বলছে, ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারছে না। এবিটিএ-র পশ্চিম বর্ধমানের জেলা সম্পাদক অমিতদ্যুতি ঘোষের আবার বক্তব্য, ‘‘অনলাইন ক্লাস নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অভিজ্ঞতাও কম। ফলে কবে, কী ভাবে সিলেবাস শেষ হবে, পুরোটাই অনিশ্চিত।’’ প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে হাতেকলমে বোঝানোর বিষয় অনলাইনে বোঝাতে আর বুঝতেও বেগ পেতে হচ্ছে। কৃষ্ণনগরের এক গৃহশিক্ষক দেবীপ্রসাদ সরকারের কথায়, “বিজ্ঞান কি অনলাইনে সবটা বোঝানো যায়? বিশেষ করে অনেক ছবি আঁকার থাকে। ডায়াগ্রাম থাকে।”

সঙ্কট নিরসনের পথ খুঁজছেন সকলেই। বার্নপুরের শান্তিনগর বিদ্যামন্দিরের উদ্যোগে যেমন বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় শিবির করে গাছতলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। বহু জায়গায় শিক্ষকেরা বাড়ি গিয়ে পড়া বুঝিয়ে আসছেন। গৃহশিক্ষকেরাও ই-ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু সে সবই সীমিত উদ্যোগ। বহু ক্ষেত্রে বাধাও আসছে। বাঁকুড়ার ইঁদপুরের জোড়দা নিউ মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চঞ্চল নাথ বললেন, “আমরা গ্রামে গিয়ে পড়ুয়াদের পড়ানোর কথা ভেবেছিলাম। তবে অভিভাবক ও গ্রামবাসীর একাংশ করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় আমাদের যেতে নিষেধ করছেন।”

এই অবস্থায় চলতি শিক্ষাবর্ষে নির্দিষ্ট সময়ে সিলেবাস শেষ করা কার্যত অসম্ভব বলেই জানাচ্ছেন অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা। সিঙ্গুরের পলতাগড় রাধারানি শিক্ষামন্দিরের প্রধান শিক্ষক দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস শেষ করতে অন্তত ৩ মাস অতিরিক্ত সময় দরকার।’’ দক্ষিণ বারাসতের শিবদাস আচার্য উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবদীপ ভট্টাচার্য জানালেন, পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়াদের স্কুলে ডেকে ছোট গ্রুপে ক্লাস করানো যায় কি না পরিকল্পনা চলছে।

প্রস্তাব-পরিকল্পনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘরবন্দি পরীক্ষার্থীদের মনের উপর চাপ বাড়ছে। জীবনের বড় পরীক্ষার দোরগোড়ায় প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা দিচ্ছে তারা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement