খাঁচায় ফিরল টাইগার, তৃণমূল নিস্পৃহই

কালীঘাট থেকে কামারহাটি। ফুঁসে উঠছে না কেউ! ভিতরে ভিতরে দুঃখ পাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু বাইরে সে সব প্রকাশ করার জো নেই!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:২৫
Share:

বৃহস্পতিবার মধ্যরাত্রে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ঢোকানো হচ্ছে মদন মিত্রকে। ছবি:সুমন বল্লভ।

কালীঘাট থেকে কামারহাটি। ফুঁসে উঠছে না কেউ! ভিতরে ভিতরে দুঃখ পাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু বাইরে সে সব প্রকাশ করার জো নেই!

Advertisement

জামিন পাওয়ার সময় থেকেই ইঙ্গিত ছিল। জামিন খারিজ হওয়ার সময় সেই ইঙ্গিত আরও স্পষ্ট হল! সারদা-কাণ্ডে নাম জড়িয়ে জেলে যাওয়া মদন মিত্রের সঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে দূরত্ব রাখতেই সচেষ্ট থাকল তাঁর দল! কালীঘাট হোক বা কামারহাটি। উল্টে বিরোধীদের কাছ থেকে কটাক্ষ শুনতে হল— মন্ত্রিত্ব এবং জামিনের স্বস্তি দু’টোই হারিয়ে মদনের আসলে এ’কূল-ও’কূল, দু’কূলই গেল!

মাত্র কু়ড়ি দিন আগে যে এলাকার রাস্তায় ‘বাঘের প্রত্যাবর্তনে’র (টাইগার ইজ ব্যাক) ঘোষণা হয়েছিল সোৎসাহে, সেখানে বৃহস্পতিবার শুধুই নীরবতা! কোথাও কোনও আলোচনা নেই! গত ৩১ অক্টোবর মদনের জামিনের খবর ছড়িয়ে পড়তেই কামারহাটি জুড়ে শুরু হয়েছিল অকাল দিওয়ালি। সেখানে এ দিন জামিন বাতিলের খবর পেয়েও প্রায় মুখ বুজেই থাকলেন তৃণমূল নেতারা। এক নেতার দাবি, ‘‘সব সিবিআইয়ের চক্রান্ত!’’ তা হলে চক্রান্ত জেনেও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে না কেন? নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতার মতো গোটা কামারহাটির সব তৃণমূল নেতা-কর্মীই এক সুরে বলছেন, ‘‘দল না বললে এ সব কিছু করা যাবে না!’’

Advertisement

দল যে এমন কিছু বলবে না, তার ইঙ্গিতও তো প্রকট! কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ‘সদ্যপ্রাক্তন’ মন্ত্রী মদনের জামিন খারিজ করে দেওয়ার পরে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাননি শাসক দলের কোনও নেতা। দলের তরফে কোনও বিবৃতিও জারি করা হয়নি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বিকালে পটনা রওনা হয়ে গিয়েছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নীতীশ কুমারের ফের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তার আগে দলের দুই শীর্ষ নেতার কাছ থেকে তিনি মদন-মামলা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। কিন্তু বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে মদন সংক্রান্ত প্রশ্নের কোনও জবাব তিনি দেননি। তাঁর আর এক আস্থাভাজন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও ‘বিচারাধীন বিষয়’ বলে মন্তব্য এড়ি়য়ে গিয়েছেন। আর পটনা পৌঁছে রাতে মমতা ফেসবুকে পোস্ট করেছেন বাংলাদেশের ভারতীয় ছিটমহল থেকে এ দেশে আগত মানুষদের স্বাগত জানিয়ে! দলের বহু দিনের সৈনিক মদনের জামিন খারিজ হয়ে জেলে ফেরত যাওয়ার দিনে তাঁর নেত্রীর মন্তব্যের বিষয় নির্বাচনই কামারহাটির বিধায়কের প্রতি তৃণমূলের মনোভাব বুঝিয়ে দিচ্ছে বলে শাসক দলের অন্দরের ব্যাখ্যা।

পড়ুন: মন্ত্রিত্ব ছেড়েও লাভ হল না, জেলেই যেতে হল মদন মিত্রকে

তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘নিম্ন আদালত থেকে মদন জামিন পাওয়ার পরেও সরকারের মধ্যে আশঙ্কা ছিল, হাইকোর্টে ওই নির্দেশ উল্টে যাবে। জামিনের শুনানি চলাকালীন হঠাৎ মদনের ইস্তফা মঞ্জুরের সিদ্ধান্তও অঙ্ক কষে নেওয়া। উপরে উপরে এটা মদনকে সাহায্য। যাতে ওঁর আইনজীবী আদালতে বলতে পারেন, মদন আর প্রভাবশালী নন। কিন্তু আদালত জামিন খারিজ করে দিলে আবার দেখানো যায়, মদন দলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নন!’’ ঠিক সেই চিত্রনাট্য মেনেই এ দিন দলের তরফে কেউ মদন বিষয়ে মুখই খোলেননি! একান্ত আলাপচারিতায় নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘কালির দাগ গায়ে রাখতে চান না দলনেত্রী! সে কুণাল ঘোষ হোক আর মদন মিত্র!’’

বিরোধীরা স্বভাবতই এমন ঘটনাকে হাতিয়ার করতে ছাড়ছে না। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র টুইট করেছেন, ‘‘মদন মিত্রকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রী ব়ড্ড তাড়াতাড়ি নিলেন। গত এক বছরে তিনি এই কাজ করার সময় পেলেন না! এখন যা হল, তাতে মদনের এ কূল-ও কূল, দু’কূলই গেল!’’ সূর্যবাবু আরও বলেছেন, মদন মন্ত্রী থাকলেন কি না বা জামিন পেলেন কি না, সেটাই শেষ কথা নয়। প্রতারিত মানুষের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে, এই দাবিতে তাঁদের আন্দোলন চলবে। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশের পিছনে যাঁর মামলার বিশেষ ভূমিকা ছিল, সেই কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেছেন, ‘‘মদন মিত্র চালাকির দ্বারা অপরাধকে চাপা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিরা প্রমাণ করে দিলেন, চালাকির দ্বারা বিচারব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করা যায় না!’’

হাইকোর্টের সিদ্ধান্তে অবশ্য স্বস্তি পেয়েছে বিজেপি! মদনের জামিন মঞ্জুর হওয়ায় তৃণমূল-বিজেপি’র বোঝাপড়়া নিয়ে সরব হয়েছিল বাম ও কংগ্রেস। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন তাই বলেছেন, ‘‘জামিনের দিনই আমি বলেছিলাম, এই রায় উচ্চ আদালতে টিকবে না। জেলের পাখিকে জেলেই ফিরতে হবে! সিপিএম এবং কংগ্রেস আমাদের সঙ্গে তৃণমূলের সখ্যের ধুয়ো তুলেছিল। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আজ তাদের জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া উচিত!’’ হাইকোর্টে মদনের জামিন সংক্রান্ত মামলার শুনানির মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে সারদা-যোগই স্পষ্ট করে দিয়েছেন বলে রাহুলবাবুর দাবি। বাম ও কংগ্রেস নেতারা অবশ্য বলছেন, নিম্ন আদালতে জামিনের সময় সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছিল বলেই তাঁরা বিজেপি-তৃণমূল বোঝাপ়়ড়ার কথা বলেছিলেন। হাইকোর্টে সেই ‘ভুল’ সিবিআই শুধরে নিয়েছে।

পড়ুন: টেনশন কাটাতে মদনের মুখে দিনভর সাদা পান

সিবিআইয়ের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে অবশ্য রুষ্টই আছে কামারহাটির মদন অনুগামী শিবির। বিধায়ক ৩২৪ দিন পরে জামিন পেতেই গোটা কামারহাটির তৃণমূল পটকা ফাটিয়েছিল, মিষ্টি বিলিয়েছিল। ‘দাদা’র জামিনের খবর পেয়ে পুরসভার বৈঠক থেকে সর্বপ্রথম বাইরে বেরিয়ে এসে আতসবাজি পুড়িয়েছিলেন যিনি, সেই চেয়ারম্যান পারিষদ (স্বাস্থ্য) বিমল সাহাকে এ দিন কামারহাটি পুরসভার মিটিং রুমের বাইরে পায়চারি করতে দেখা গিয়েছে। মুচকি হেসে বলছেন, ‘‘আজও চেয়ারম্যান পরিষদের বৈঠক আছে!’’ জামিন পাওয়ার খবরে তো বৈঠক ভেস্তে গিয়েছিল। জামিন বাতিলের খবরে কিছু করবেন না? বিমলবাবুর উত্তর, ‘‘আমরা কেউই আইনের উপরে নই। আর দলীয় নেতৃত্ব তো কোনও প্রতিবাদ মিছিল করতে বলেননি!’’

কামারহাটির প্রাক্তন বিধায়ক, সিপিএমের মানস মুখোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘জামিনের নির্দেশকে সত্যের জয় বলে তৃণমূল মিছিল করেছিল। জামিন বাতিল হতে এখন কি আদালতের বিরুদ্ধে মিছিল হবে?’’ কামারহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল সাহা জবাব দিচ্ছেন, ‘‘আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার এক্তিয়ার কারও নেই! মদন মিত্র যে আইনে জামিন পেয়েছিলেন, সেই আইনের পথ ধরেই ফের তাঁকে মুক্ত করার চেষ্টা চালাতে হবে!’’

মেঘনাথ চক্রবর্তী, সুজন সরকারের মতো স্থানীয় নেতারা আশায় আছেন, ‘চক্রান্ত’ সরিয়ে আবার সুদিন আসবে। এ সবের মাঝে পুরসভার ফটকের বাইরে ঝুলেই আছে ব্যানারটা— ‘টাইগার ইজ ব্যাক’! ব্যানারটাই পড়ে আছে, টাইগার তো ফের খাঁচায়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement