Lok Sabha Election 2019

দিনের শেষে ফুরফুরে সায়ন্তন, আত্মবিশ্বাসী নুসরত বসিরহাট ছাড়লেন দুপুরেই

কার এল আর কার গেল, স্পষ্ট হবে ২৩ মে। কিন্তু রবিবার দিনভর বসিরহাট বুঝিয়ে দিল, মেরুকরণই শেষ কথা বলতে চলেছে এই আসনে। তবে মেরুকরণ যতই তীব্র হোক, সংগঠন বলতে প্রায় কিছুই না থাকলে তৃণমূলের মতো দলের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে জিভ বেরিয়ে যাওয়ার হাল হয়।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

বসিরহাট শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৯ ২২:৩৭
Share:

নুসরত ও সায়ন্তন বসু।

দৃশ্য ১: নুসরত জাহান।

Advertisement

বেশ বেলা করেই বেরলেন বাড়ি থেকে। নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্র থেকে অনেকটা দূরে থাকেন যে প্রার্থী, কলকাতায় ভোট দিয়ে সকাল ন’টার আগে, লড়াইয়ের ময়দানের দিকে রওনা হতে না পারা তো বেলা গড়িয়ে যাওয়ারই সামিল তাঁর জন্য। রওনা হওয়ার পরে বসিরহাট সংসদীয় আসনের সীমানায় ঢুকেই যে ভোটের তদারকি শুরু করলেন, তেমনও কিন্তু নয়। বাসন্তী হাইওয়ে হয়ে ঢুকলেন নিজের কেন্দ্রের সীমানায়, থামলেন গিয়ে সরাসরি টাকিতে, আর এক প্রান্ত। প্রথমে টাকি রামকৃষ্ণ মিশনের বুথ, তারপর টাকি গভর্নমেন্ট হাইস্কুল। সেখান থেকে সোজা বসিরহাট। কয়েকটা ওয়ার্ডে বুথ পরিদর্শন, কয়েকটা রাস্তায় গাড়ির হুড খুলে দিয়ে প্রায় অঘোষিত রোড শো। তারপরে বসিরহাট উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কার্যালয়ে পৌঁছে বিরিয়ানিতে মধ্যাহ্নভোজ। দুপুর ১টা ৫০ নাগাদ লড়াইয়ের ময়দান ফেলে রেখে রওনা হয়ে যাওয়া কলকাতার উদ্দেশে।

দৃশ্য ২ : সায়ন্তন বসু।

Advertisement

সাত সকালেই সল্টলেকে নিজের বুথে ভোটটা দিলেন। তারপরে বাইপাস হয়ে বাসন্তী হাইওয়ে। প্রথমেই ঢুকলেন মিনাখাঁ। বেশ কয়েকটা বুথ থেকে গোলমালের খবর আসতে শুরু করেছে, বেশ কয়েকটা গ্রামে বিজেপি সমর্থকরা ‘ভয়ে’ ভোট দিতে বেরচ্ছেন না বলে জানতে পেরেছেন প্রার্থী। নিজেই হাজির হলেন সেই রকম কয়েকটা গ্রামে। চটপট ফোন মিলিয়ে অভিযোগ জানালেন কমিশনে, চেয়ে পাঠালেন কেন্দ্রীয় বাহিনী, সাহায্য চাইলেন কুইক রেসপন্স টিমের। যতগুলো বুথ থেকে গোলমালের খবর এসেছিল, সেই সবগুলোর সমস্যা মেটাতে পারলেন না ঠিকই, কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনী হাজির করিয়ে বেশ কয়েকটা বুথে ভোটারদের আত্মবিশ্বাস বাড়ালেন, বুথমুখীও করলেন। তারপর বসিরহাট দক্ষিণ, বসিরহাট উত্তর এবং হাড়োয়া বিধানসভার বিভিন্ন অংশে বাঁই বাঁই চক্কর। বেলা আড়াইটে নাগাদ ঘোড়ারাসে দলীয় কর্মীর বাড়িতে জমজমাট মধ্যাহ্নভোজ। শেষবেলায় পৌঁছে যাওয়া টাকি, হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জের দিকেও। ভোট পরবর্তী অশান্তির আশঙ্কায় সন্ধের পরেও বেশ কিছু ক্ষণ ঘাঁটি গেড়ে থাকা বিদ্যাধরী আর বাংলাদেশের মাঝে। ফেরার সময় কর্মীদের জানিয়ে দেওয়া, “রাতে বসিরহাটেই থাকছি, কোনও সমস্যা হলেই খবর দিন।”

বাংলাদেশ আর সুন্দরবন লাগোয়া বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে মূল লড়াই যে দু’জনের মধ্যে, রবিবার সকাল থেকে সেই নুসরত জাহান এবং সায়ন্তন বসুর রুটিনের মধ্যে এই রকমই চোখে পড়ার মতো ফারাক ধরা পড়ল। জয়ের ব্যাপারে কি এতটাই আত্মবিশ্বাসী নুসরত? আর সায়ন্তন কি প্রবল টেনশনে? বিজেপি কর্মীদের দাবি, বিষয়টা ঠিক উল্টো। “নুসরত বুঝে গিয়েছেন, বসিরহাটে তাঁর কপাল খুলবে না। তাই হাল ছেড়ে মাঝপথেই ফিরে গিয়েছেন।” বিজ্ঞের মতো হেসে বলছেন রবিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সায়ন্তনের সঙ্গে থাকা স্থানীয় বিজেপি নেতা। আর উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত বলছে, “দাদা (জ্যোতিপ্রিয়) রয়েছেন তো! একাই সব সামলে নিচ্ছেন। নুসরতদি বসিরহাটে আজ না গেলেও কিছু আসত-যেত না।”

কার এল আর কার গেল, স্পষ্ট হবে ২৩ মে। কিন্তু রবিবার দিনভর বসিরহাট বুঝিয়ে দিল, মেরুকরণই শেষ কথা বলতে চলেছে এই আসনে। তবে মেরুকরণ যতই তীব্র হোক, সংগঠন বলতে প্রায় কিছুই না থাকলে তৃণমূলের মতো দলের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে জিভ বেরিয়ে যাওয়ার হাল হয়।

আরও পড়ুন: নিউটাউনে বুথের পাশে বাড়িতে ‘অন্নপ্রাশন’! শিশুর খোঁজ করতেই ছুট ‘অতিথি’দের

সাম্প্রদায়িক অশান্তির ক্ষত এখনও দগদগে বসিরহাটের বুকে। এ বারের ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণ যে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে চলেছে এই আসনে, সে বিষয়ে তৃণমূল-বিজেপি দু’পক্ষই একমত। কোন মহল্লায় কোন ফুল আঁকা ঝান্ডা দেখতে পাওয়া যাবে, তা যেন আগে থেকেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল। প্রায় প্রতিটা আন্দাজ মিলেও যাচ্ছিল। এই অভুতপূর্ব বিভাজনের ভরসাতেই বিজেপি কর্মীরা চনমন করছেন বসিরহাট জুড়ে। তৃণমূল একই কারণে আত্মবিশ্বাসী, যেন পাত্তাই দিচ্ছে না বিজেপি কর্মীদের উৎসাহ-উদ্দীপনাকে। দু’দলই মনে করছে, মেরুকরণে তাদেরই লাভ। তবে এ সব কথা হেঁকে ডেকে বলছেন না কেউ, বলছেন একটু ফিসফিসানির ঢঙে।

যে ছন্দে রবিবার ভোট হল বসিরহাটে, তাতে প্রকাশ্য হিংসার ছবি খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে হাসনাবাদ থানার ভাবনীপুর ১ নম্বর অঞ্চল, বসিরহাট উত্তর বিধানসভার আমলানি অঞ্চল এবং সন্দেশখালি, হাড়োয়া ও শাসনে সন্ত্রস্ত আবহ তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল সকাল থেকেই। বিজেপি প্রার্থী সায়ন্তন বসু দাবি করছিলেন, “অনেকগুলো গ্রামে ঘর থেকে বেরতেই দেওয়া হয়নি ভোটারদের। ভোটের আগের রাত থেকে হুমকি-শাসানি শুরু হয়েছে। প্রকৃত ভোটারদের আটকে দিয়ে ভুয়ো ভোট দেওয়া চলছে।” সকাল ১১টার পর থেকে এই সব অভিযোগ বাড়তে শুরু করে। দুপুর ১টায় বেশ টেনশনে সায়ন্তন। কিন্তু আড়াইটের পর থেকে আবার মেজাজ ফিরতে শুরু করে গেরুয়া শিবিরে, খুলে যেতে থাকে তৃণমূলের অভিযোগের ঝাঁপি। কেন্দ্রীয় বাহিনী সাধারণ ভোটারদের উপর অত্যাচার করছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী পদ্মফুলে ছাপ দিতে বলছে, বিজেপিকে ভোট না দিলে গুলি করার হুমকি দিচ্ছে— এই রকম অভিযোগ তুলতে শুরু করেন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা। শাসনের দিকেই মূলত এই রকম ঘটছে বলে অভিযোগ আসতে থাকে। এই সব অভিযোগের পাল্টা জবাব নিয়ে তখন প্রস্তুত সায়ন্তন। তিনি বলতে থাকেন, “শাসনে যতটা রিগিং করবে বলে তৃণমূল পরিকল্পনা করেছিল, ততটা করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় বাহিনী রুখে দিয়েছে। সেই জন্যই বাহিনীর উপর এত রাগ।”

আরও পড়ুন: আরাবুল বাহিনীকে রুখতে ভাঙড় চষে বেড়ালেন বিকাশ, বুথমুখী হলেন ভোটাররা

শাসনে যা-ই হোক, হিঙ্গলগঞ্জ এবং সন্দেশখালির বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের অভাবে বিজেপি রুখতে পারেনি তৃণমূলের ‘ভোট করা’। হিঙ্গলগঞ্জ নিয়ে চিন্তা কম থাকলেও সন্দেশখালি নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়ে গেল বলে সন্ধে ৬টায় বেশ অকপটেই জানালেন বিজেপি প্রার্থীর সর্বক্ষণের সঙ্গীরা। হাড়োয়ায় যে তৃণমূলের থেকে অনেকখানি পিছিয়ে থাকতে হবে, ভোট শেষ হওয়ার পর সে কথাও বিজেপি নেতারা অস্বীকার করলেন না। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও যাবতীয় কাটাছেঁড়া সেরে নিয়ে সন্ধে নাগাদ বেশ ফুরফুরেই হয়ে উঠলেন বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী। দিনভর দৌড়ঝাঁপে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চেহারা। কিন্তু চোখে মুখে বেশ স্বস্তির ছাপ, ঠোঁটের কোণে টেনশন মুক্তির হাসি। ঠিক কত ভোটারকে আটকে দিতে পেরেছে তৃণমূল, ঠিক কত ছাপ্পা মেরেছে, তার একটা কমবেশি হিসেব যেন তখন সায়ন্তনের চোখের সামনে ভাসছে এবং তাঁর মনে হচ্ছে এই হিসেবে স্বস্তি পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

সায়ন্তনের প্রতিপক্ষ নুসরত কিন্তু তখন এ সবের থেকে অনেক দূরে। বসিরহাটের ত্রিসীমানাতেও নেই তিনি, তাঁর ত্রিসীমানাতেও নেই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই সব চুলচেরা বিশ্লেষণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement