ঝলসানো রোদে গলিপথে হাঁটছেন। পাশ থেকে চলে যাওয়া মুখ তাঁকে চিনছে না। জানবাজারের ঘিঞ্জি পথে অতিথি আবাসের সামনে শাসক দলের বিধায়কের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই এগিয়ে গেলেন ভোট-প্রার্থনায়। এক লহমায় বিধায়ক চিনতেই পারলেন না ভোট-প্রার্থীকে।
আঁচল গাছ-কোমর করে বাঁধা, হাতজোড়ে কলকাতা উত্তরের অলি-গলি-পাকস্থলী, বাজার-পাড়ায় হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে চেনাচ্ছেন প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা। বলছেন, ‘‘কাস্তে, হাতুড়ি, তারা আমার প্রতীক। আমি আপনাদের পাশে থাকব। জেলে যাব না। টাকা চুরি করব না!’’ রাজধানী শহরের ভোটে তাঁর দল অনেক দিনই দুর্বল। তবু গোটা কলকাতা সিপিএম দু’ভাগ হয়ে উত্তরে তাঁর আর দক্ষিণে নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ের হয়ে নেমে গিয়েছে লড়াইয়ে। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদক এবং সিপিএম প্রার্থী কনীনিকা বসু (ঘোষ) সোজাসাপ্টাই বলছেন, ‘‘এলাকায় কাউন্সিলর, বিধায়ক, সাংসদ সবই শাসক দলের। আমাদের সংগঠন এখানে এখন আগের মতো নেই। প্রার্থী হিসেবে আমাকে তাই প্রত্যেক ভোটারের কাছে পৌঁছতে হচ্ছে। অনেক বেশি খাটতে হচ্ছে।’’ কখনও সমকামী মহিলা-পুরুষ, উভকামী, রূপান্তরকামীদের সঙ্গে, কখনও ছাত্র-ছাত্রী বা সিনিয়র সিটিজেন, আবার কখনও প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে আলাদা করে মুখোমুখি বসছেন কনীনিকা।
উত্তর কলকাতার প্রতি ইঞ্চি সাত-সাত জন বিধায়ক আর পঞ্চাশ কাউন্সিলরের ‘দখলে’ রেখেছে তৃণমূল। তা জেনেই সকাল-সন্ধ্যে এক ফুট চওড়া ছোট গলিপথের ঝুপড়ি ঘরও বাদ দিচ্ছেন না ঘামে ভেজা গেরুয়া উত্তরীয়। পাঁচ বছর আগে পদ্ম প্রতীকে নিজেকে অনেকটাই চিনিয়েছিলেন। তবে পারেননি দশ বছরের সাংসদকে ‘প্রাক্তন’ করে দিতে। সেই চেনা প্রতিপক্ষকে এ বার তাঁর সঙ্গেই পাঞ্জা লড়তে হবে, বাড়তি প্রত্যয়ে বারবারই বুঝিয়ে দিচ্ছেন পাঁচ বছর আগে ৯৬ হাজার ২২৬ ভোটে পরাজিত বিজেপির রাহুল সিংহ। গত বার গেরুয়া শিবিরের ভোট বেড়েছিল প্রায় ২১%। এ বার ‘আত্মবিশ্বাস’ তাঁর শরীরী-ভাষায়।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এক নজরে - কলকাতা উত্তর
• ভোটার: ১৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৬১০
• ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। জয়ের ব্যবধান ৯৬ হাজার ২২৬
• ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে এগিয়ে তৃণমূল। মোট ৭টি বিধানসভার মধ্যে ৭টিতেই তৃণমূল জয়ী
উঁচু উঁচু বাড়ি, উঁচু বারান্দা, জানলা থেকে সমর্থনের হাত দেখে রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি, অধুনা সর্বভারতীয় সম্পাদক বলছেন, ‘‘যতই ওদের শক্তি থাকুক, এ বার পদ্ম-হাওয়ায় ঘাসফুল শুকিয়ে যাবেই।’’ জামিনে মুক্ত বর্ষীয়ান সাংসদকে গত পাঁচ বছরের মধ্যে দু’বছর এলাকায় দেখাই যায়নি বলে ছোট ছোট সভায় ভোটারকে বোঝাচ্ছেন রাহুল। বলছেন, ‘‘মানুষের টাকা আত্মসাৎ করে এখানকার সাংসদ বিদেশ গিয়েছেন। রোজভ্যালি-কাণ্ডে জেলে থেকেছেন। উনি লুটেরা। এলাকার উন্নয়ন কিছুই করেননি।’’
আর্দ্র-ভ্যাপসা ঝিমধরা সাঁঝ-পথে রাহুল বলছেন, ‘‘গত বার তৃণমূলের বিপক্ষকে চিনে নিতে মানুষ দ্বিধায় পড়েছিলেন। কংগ্রেস আর সিপিএমের ভোট-কাটাকাটিতে জিততে পারিনি। কিন্তু এ বার এখানে লড়াই তৃণমূল-বিজেপির।’’
হয়তো তাই। কিন্তু তাই বলে বসে নেই শাহিদ ইমাম। সংখ্যালঘু এই আইনজীবী হাতে গোনা কিছু কর্মী নিয়ে ঘুরছেন বাছাই করা পাড়ায়। উত্তর কলকাতার প্রায় ২৫% সংখ্যালঘু ভোটের অনেকটাই ‘হাত’ গুছিয়ে তুলে নিত কংগ্রেস। এলাকার দাপুটে নেতা, অধুনা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের সৌজন্যে। সেই সোমেনেরই দলীয় প্রার্থী কি এ বার সংখ্যালঘু ভোট ‘হাত’-এ টানতে পারবেন? সোমেনবাবু আশাবাদী, ‘‘পুরোটা না পারলেও ভাল সংখ্যায় সংখ্যালঘু ভোট এ বারও কংগ্রেস টানতে পারবে বলেই মনে হচ্ছে।’’ কংগ্রেস প্রার্থী শাহিদ বলছেন, ‘‘সংখ্যালঘু ভোট ভালই পাব বলে বুঝছি। তবে হিন্দু ভোটও কংগ্রেসকে মানুষ দেবে। আমি তো এলাকার ছেলে। আর সঙ্গে সোমেনদা তো আছেনই।’’ অবাঙালি এই সংখ্যালঘু ভোট যে কিঞ্চিৎ ‘কাঁটা’, তা স্বীকার করছে বিজেপি-তৃণমূল দু’পক্ষই।
তার উপরে চার মাস হাজতবাসের দিনরাত এখনও তাড়া করে বিদায়ী সাংসদ ও তৃণমূলের প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তৃণমূলের লোকসভার নেতা হিসেবে বিজেপির বিরুদ্ধাচারণের ‘শাস্তি’ ওই কারাবাস ছিল বলে কর্মিসভায় দাবি করছেন তিনি। বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষের ‘আবেগ’ কাড়তে তৃণমূলের উত্তর কলকাতার জেলা সভাপতি সুদীপ বলছেন, জেলে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে কী ভাবে থাকতে হত, কী ভাবে থালা হাতে জেলের দেওয়া খাবার নিতে লাইনে দাঁড়াতে হত। কারাবাসের জন্য এলাকায় না-থাকার অভিযোগ নস্যাৎ করতে গিয়ে বলছেন, ‘‘দু’বছর ছিলাম না, এটা মিথ্যে। জেল-হাসপাতাল মিলিয়ে মাস ছয়েক ছিলাম না। আমি উত্তর কলকাতার সব গলি, রাস্তা চিনি।’’
শুধু চিন্তা তাঁর এলাকায় বিরোধীদের হাতে থাকা ১০টি ওয়ার্ড নিয়ে (উত্তর কলকাতায় ৬০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫০টিই তৃণমূলের দখলে)। ভাবাচ্ছে বড়বাজারের পোস্তা, জোড়াবাগান, নিমতলা, জোড়াসাঁকোর মতো এলাকা। বিধানসভা ভোটে এখানে গেরুয়া-হাওয়া তেমন জোরাল ছিল না। তা সত্ত্বেও পোস্তার সেতুভঙ্গের ধাক্কায় ২০১৬ সালে জোড়াসাঁকো বিধানসভায় বিজেপির রাহুলের থেকে মাত্র ছ’হাজার ভোটে এগিয়ে জিতেছিলেন তৃণমূলের স্মিতা বক্সী। তাই বাড়তি ‘নজর’ দিতে বারবার ওই এলাকাগুলিতে চক্কর কাটতে হচ্ছে সুদীপকে।
যদিও দলের কাউন্সিলর, বিধায়কদের ‘লিড’ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে বলে সুদীপ আশাবাদী। গত বার জিতলেও প্রায় ১৭% ভোট কমেছিল সুদীপবাবুর। তাই ‘লিড’ বাড়াতে সকাল-সন্ধ্যে হুডখোলা জিপে ঘণ্টা তিনেক করে এক একটি এলাকায় ঘুরছেন। রণ-পা, তেরঙা বেলুনের মধ্য দিয়ে তাঁর মিছিল যাচ্ছে। পথচলতি বাসিন্দা, স্কুলপড়ুয়াদের দেওয়া ফুল, মালায় ভরে নিমেষে উপচে পড়ছে হুডখোলা গাড়ি, গাড়ির বনেট।
নিশ্চিন্ত ভাতঘুম সেরে সুদীপ বলছেন, ‘‘বিধানসভা, লোকসভা মিলিয়ে উত্তর কলকাতায় আমি আট বার জিতেছি। এ বার নবম বারের জন্য জয় নিশ্চিত। এখন লক্ষ্য শুধু মার্জিন বাড়ানোটাই।’’
কত হবে সেই মার্জিন? সুদীপ বোঝান, ‘‘সংগঠনে, শক্তিতে কোনও ভাবেই বিরোধীরা আমাদের লেজটুকুও ছুঁতে পারবে না! মার্জিন গত বারের থেকে অনেক বেশিই হবে।’’
প্রধান প্রতিপক্ষ রাহুলের প্রত্যয়, ‘‘মার্জিন কী হবে জানি না! তবে ছ’মাস আগেই আমার জ্যোতিষী বলে দিয়েছেন, আমিই জিতব!’’