মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: তৃণমূলের টুইটার হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত।
ষষ্ঠ দফার নির্বাচনেও হিংসা এড়ানো যায়নি। তা নিয়ে এ বার বিজেপির উপর ক্ষোভ উগরে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার বারুইপুরে নির্বাচনী সভা ছিল তাঁর। সেখান থেকেই মোদী সরকার ও বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দাগেন তিনি।
কেন্দ্রীয় বাহিনী নামিয়ে বাংলায় বিজেপি গুন্ডামি করছে বলে এ দিন অভিযোগ তোলেন মমতা। তিনি বলেন, “সকাল থেকে অত্যাচার করছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। অনেক জায়গায় মারধর করেছে ওরা। আইনশৃঙ্খলা কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিষয়ই নয়। রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে পড়ে ওটা। তা সত্ত্বেও বেআইনি ভাবে সারাদিন ছেলে-মেয়ে, এমনকি সাংবাদিকদের পিটিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। সব নরেন্দ্র মোদীর কথায়। ধিক্কার জানাই ওদের।”
বিজেপির উদ্দেশে তোপ দেগে মমতা বলেন, “ওরা ভাবছে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে ভোট করিয়ে দিয়ে যাবে। মানুষের ভোটগুলো কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে দেবে। কিন্তু ওরা ভাবতে পারে না, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বন্দুকের আঘাতে বাংলার মানুষের মাথা নত করা যায় না। এটুকু বুদ্ধি ওদের নেই।”
আরও পড়ুন: কলকাতায় পর পর দু’জায়গায় মুকুল রায়ের গাড়ি থামিয়ে পুলিশি তল্লাশি
এ দিন মমতা আরও বলেন—
সিবিআই, ইডি দেখিয়ে সকলকে ভয় দেখিয়ে রেখেছে, কিন্তু আমাকে ভয় দেখাতে পারেনি। এনআরসি-র নামে অসমে ২২ লক্ষ হিন্দুর নাম বাদ দিয়ে দিলেন, তখন হিন্দুত্বের কথা মনে ছিল না। আসলে ওদের উদ্দেশ্যই হল বাঙালি খেদাও, আর এখানে এসে মমতা খেদাও। সারা ক্ষণ আমাকে তোলাবাজ বলে চলেছেন। এক জন প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন ভাষা শোভা পায়? কত বড় সাহস, কত বড় ঔদ্ধত্য এবং অহঙ্কার হলে এমন কথা বলা যায়! ওঁদের এক নেতা বলেছিলেন, আমাদের নেতার ৫৬ ইঞ্চির কাঁধ। আমি বলেছিলাম, সে তো রাবণেরও ছিল। তাই বলে কি রামচন্দ্র তাকে বধ করেনি! এত মিথ্যা বলেন বলেই মাটির লাড্ডু দেব বলেছি, যাতে দাঁত ভেঙে যায়। ওঁর কথা মতো স্লোগান দেব কেন? অত সস্তা! দুটো স্লোগান শিখেছি আমরা, সেগুলোই বলব আমরা। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু শিখিয়েছিলেন জয় হিন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র শিখিয়ে গিয়েছেন বন্দে মাতরম। ওই দুটোই দেব আমরা। তোমাদের ধার করা স্লোগান নিতে যাব কেন? বাংলা অনেক কিছু দিয়েছে দেশকে, উনি পাঁচ বছরে দেশকে শুধু গাড্ডা দিয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কোথায় ছিল? আজ হিন্দুধর্ম শেখাতে এসেছে। বলে মমতাদি সরস্বতী পুজো করতে দেন না, তা হলেই বুঝুন। ঘরে ঘরে, পুজো হয়। স্কুল, কলেজ কোথাও বাদ যায় না। তা হলে মিথ্যা কথা বলছেন কেন? আমাদের সংস্কৃতিকে অপমান করার অধিকার কে দিয়েছে ওঁকে। হিন্দুত্ব ওদের থেকে শিখতে হবে না। বলে আমি নাকি দুর্গাপুজো করতে দিই না। এত বড় মিথ্যা বলে যে, তাঁর প্রধানমন্ত্রী থাকা উচিত? আমি মিথ্যা বললে ১০০ বার ওঠবোস করতে রাজি আমি। উনি মিথ্যা বললে ওঁকেও করতে হবে। এখানে এসে বলছে, ৪০ জন তৃণমূল নেতা বিজেপিতে যোগ দেবে বলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উনি যেন হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন, কখন আসবেন তৃণমূল নেতারা। প্রধানমন্ত্রী হয়ে মিথ্যা কথা বলে লজ্জা করে না? বছর দুয়েক আগে আমাকে ওদের এক মন্ত্রী ফোন করে মোদীর বিরুদ্ধে কথা বলতে বারণ করছিলেন। আমি বলে দিয়েছিলাম, আপনি ঠিক করবেন, আমি কী বলব আর কী না বলব? আপনি কি আমার অভিভাবক? সবাইকে এ ভাবেই ভয় দেখায় ওরা। আমার কথা বাদ দিন, মোদীর বিরুদ্ধে একটা কথা বলতে পারে না জাতীয় চ্যানেলগুলিও। তা হলেই চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাবে, চাকরি যাবে। একটা সময় মনে হত, দাঙ্গা করে ক্ষমতায় এলেও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে হয়তো নিজেকে বদলাবেন। কিন্তু দেখলাম না, যার হয় না ন’য়ে তার হয় না নব্বইতে। হবে না। মাঝখান থেকে দেশে বিভাজন হয়ে গেল। গৌরী লঙ্কেশের মতো সাংবাদিককেও খুন করেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আপত্তি সত্ত্বেও নিজের খেয়াল খুশি মতো নোট বাতিল করেছেন মোদী। সংসদে কারও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। তা নিয়ে কাউকে কোনও কৈফিয়তও দেয়নি। যে আডবাণী রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁকেও বাদ দিয়েছেন। সব দলের সবাই খারাপ নন। অটলজিকে সম্মান করতাম। তিনি আজ নেই। পার্টিটা নিয়ে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। দেশটাকে খেয়ে নিয়েছেন। পৃথিবী জুড়ে শুধু নিজের প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। টিভি, রেডিয়ো খুলে দেখুন, খালি নরেন্দ্র মোদী, মন কি বাত, মোদী কা বাত, মোদী কা দেশ, মোদী জামা, মোদী ব্যাগ, মোদী সিনেমা, মোদী যাত্রা, মোদী নাটক। একটাই বাকি রয়েছে। নির্বাচনের পর জুতোর দোকান করে দেব। সবাই মোদী জুতো পরে হাঁটবেন। অনেক মার খেয়েছি, অনেক অসম্মানজনক কথা শুনেছি, কিন্তু তা-ও বলব সিপিএম-এর সব লোক খারাপ নন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কখনও বিজেপি সমর্থক বলব না। মিথ্যা কথা বলে কারও ভাবমূর্তি নষ্ট করে লাভ কী? উনি আমার বন্ধু নন, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরে তো ওঁদের আমলেই হয়েছে। কিন্তু ওঁর অবস্থান স্পষ্ট। উনি বিজেপির বিরুদ্ধে। জ্যোতিবাবুও হয়তো বিজেপির বিরুদ্ধেই ছিলেন। কিন্তু বেঁচে নেই তাই জিজ্ঞাসা করতে পারব না। কিন্তু আজকাল সিপিএম-এর যে নেতারা এদিক ওদিক মাথা চাড়া দিয়েছে, তারা সব বিজেপির কথায় উঠছে বসছে। যা দিচ্ছে হাত পেতে নিচ্ছে। জীবনে কম সংগ্রাম করিনি। আজও আন্দোলন করে বেঁচে রয়েছি। আন্দোলন লগ্নেই আমার জন্ম। যে দিন মারা যাব সে দিনও আন্দোলন লগ্নেই মারা যাব। বাংলার সবচেয়ে বেশি বদনাম হয়েছে সিপিএমের জন্যই। আজ ওদের হার্মাদরাই বিজেপির ওস্তাদ হয়েছে। বাংলায় এসে বলেন এখানে নাকি উন্নয়ন হয়নি। বলি ওঁর চোখে কি ন্যাবা হয়েছে! পাঁচ বছরে বিজেপি কী কাজটা করেছে। নরেন্দ্র মোদীকে বললাম আপনার সঙ্গে এক দিন বিতর্ক হোক আপনার। চ্যানেলও আপনিই ঠিক করুন। তবে টেলিপ্রম্পটার রাখা চলবে না। তো আসুন না! জেনে শুনে মিথ্যা কথা বলা আমার চরিত্র নয়, তাই মাঝেমধ্যে অপ্রিয় সত্য কথা বলে ফেলি। অমনই মানুষের কাছে খারাপ হয়ে যাই। অপ্রিয় সত্য কথা বলতে বাবাও আমাকে সাবধান করতেন ছোটবেলায়। কিন্তু তাঁর কথা রাখতে পারিনি আমি। পাঁচ বছর আগে নির্বাচনী ইস্তাহার তো প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তার একটা প্রতিশ্রুতিও কি পূরণ করতে পেরেছেন নরেন্দ্র মোদী? ইতিহাস তো বাতিল করতে শুরু করেছে। এ বার স্কুলও বাতিল করে দেবে। মুঘলসরাই স্টেশন থেকে তাজমহল সব নাম বদলাতে শুরু করেছে। মহাত্মা গাঁধীজির জায়গায় নাথুরাম গডসে এসেছে। কী না করেছে এরা? আজ এসে বলছে ভোট দাও। কেন ভোট দেবেন? নোটবাতিলের টাকায় ভোট করছে বিজেপি। নোট বাতিলের টাকা কোথায় গেল জিজ্ঞাসা করুন। কালো টাকা কোথায় গেল? এই সরকার ক্ষমতায় এলে দেখবেন এ বার ব্যাঙ্কও বাতিল করে দেবে বিজেপি। কত কষ্ট করে, ভিক্ষা করে নির্বাচন করি আমরা। বিজেপির মতো কোটি কোটি টাকা নেই আমাদের।
আরও পড়ুন: লাইভ: ঝাড়গ্রামে বিজেপি কর্মী খুন, ইটবৃষ্টি, গুলিতে রণক্ষেত্র কেশপুর
রাজ্যে নির্বাচিত সরকার রয়েছে, তার সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা রয়েছে, সব বাদ দিয়ে বিশেষ পর্যবেক্ষক নামিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তা-ও ঠিক আছে, কিন্তু সেই পর্যবেক্ষক বিজেপির কথায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে বিজেপিকে ভোট দিতে বলাচ্ছেন। লোকের ঘরে ঢুকে মারধর করছে। এটা বেআইনি। বুথের সামনে দাঁড়াতে বলা হয়েছে দাঁড়িয়ে থাকবেন, গুলি করার, লাঠি তোলার অধিকার নেই তোমার। এর আগে হাওড়ার একটি বুথে গিয়ে গুলি চালিয়েছিল। আজও গুলি চালিয়েছে। ২০১৬-তেও এ ভাবে একই ছবি দেখেছি। কম জ্বালায়নি মোদী সরকার। এ ভাবে গায়ের জোরে হয়? শুধুমাত্র একটা লোককে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে, নরেন্দ্র মোদীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে বিজেপির পার্টি অফিস থেকে যে ভাবে তালিকা করে দেওয়া হয়েছে, সে ভাবে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট সাজানো হয়েছে। এ বারের মতো বীভৎস নির্বাচন দেখিনি আমি। সাত দফায় তিন মাস ধরে নির্বাচন হওয়ার মানে টানা সব কাজ বন্ধ। কত কাজ নষ্ট হয়ে গেল। এর খেসারত কে দেবে? দেড় মাস ধরে এই গরমে ভোট চলছে। এত দিন ধরে কখনও নির্বাচন হয়?