তৃণমূল সরকারের জমানাতেই লালগড়ে কংসাবতীতে তৈরি হয়েছে বালি খাদান। রাজ্যের অন্য বালি খাদানের মতো এই বালি খাদান নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।— নিজস্ব চিত্র।
মাঝখানে কেটে গিয়েছে ন’বছর। কিন্তু তা-ও চিনতে ভুল হয়নি। গোয়ালতোড়ের মাকলি বাজারের বিজেপি কার্যালয়। লম্বাটে ঘরের দেওয়ালে জ্বলা একমাত্র এলইডি বাল্বের আলো গোটা ঘরকে পর্যাপ্ত আলো দিতে পারছে না। আবছা আলোয় গেরুয়া ফাইবারের চেয়ারে বসা ভীম মশানকে দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না।
একটা সময়ে লালগড় থেকে গোয়ালতোড় হয়ে বাঁকুড়ার সারেঙ্গা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা মাওবাদীদের সিধো-কানহু গণ মিলিশিয়ার প্রধান সিধো সরেনের ডান হাত বলা হত ভীমকে। সে সময় গোয়েন্দাদের দাবি ছিল, খোদ কিষেনজিও বেশ কয়েক রাত কাটিয়েছেন ভীমের বাড়িতে।
বিজেপির মাকলি অঞ্চল কমিটির সভাপতি চুরাশি বছরের গোরাচাঁদ দে। এক সময়ে কংগ্রেস করতেন। তার পর বিজেপিতে। তাঁর দাবি, বিশ বছর ধরে তিনি গেরুয়া ঝান্ডা ধরে আছেন এলাকায়। গোরাচাঁদ এবং তাঁর সঙ্গীরা বোঝাচ্ছিলেন, চন্দ্রকোনা পুর এলাকার একাংশ ছাড়া বাকি সমস্ত এলাকা গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে কী ভাবে তৃণমূল শূন্য হয়ে গিয়েছে। একের পর এক পঞ্চায়েত দখল করেছে গেরুয়া ব্রিগেড। গোরাচাঁদ নিজেই এর পর আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘‘এই দেখুন না ভীমকে। কমিটির এই এলাকার বড় নেতা ছিল। এখন আমাদের সঙ্গে।” গোরাচাঁদের দাবি ২০১৪ সালের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভীম এখন বিজেপির সঙ্গে।
আরও পড়ুন, পদ্ম ঘিরেই দিন ফেরার স্বপ্ন দেখেন এন্তাজ-নিয়ামতরা, বাতি জ্বালেন জামশেদ ভবনের
বিজেপি অফিস থেকে বেরনোর সময় পিছন পিছন এলেন ভীম। হাত ধরে এক পাশে টেনে নিয়ে বললেন, ‘‘২০০৮-এ এলাকায় সিপিএম নেতাদের ঔদ্ধত্য-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই অস্ত্র ধরেছিলাম। এখন সেই অত্যাচার আর দুর্নীতির জন্য আমি তৃণমূলের বিরুদ্ধে।” এর পর এক ধাপ গলা চড়িয়ে বললেন, ‘‘দিদি এত উন্নয়ন, চাকরির কথা বলছেন। সবটাই তো হয়েছে আমাদের ভয়ে। না হলে সরকার কোনও কিছুই করত না।”
তৃণমূল প্রার্থী বীরবাহার সমর্থনে দেওয়াল লিখন। বীরবাহােকে প্রার্থী বেছে নেওয়ার পিছনেও রয়েছে ছত্রধরের পরামর্শ।— ফাইল চিত্র।
২০১০-এ খড়্গপুর থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন ভীম। তিনি বললেন, ‘‘আমি এক বছরের উপর জেলে ছিলাম। সরকার আমাকে চাকরি দেয়নি। আমার মতো সিধো স্কোয়াডের গৌতম, ননীগোপাল কেউ চাকরি পায়নি। চাকরি পেয়েছে এমএলএ, নেতাদের আত্মীয়রা। যারা কোনও দিন মাওবাদী ছিল না।” ভীমের কাছেই জানতে পারলাম, এক সময় গোয়ালতোড়ে পুলিশের ত্রাস ননীগোপাল এখন কালীঘাটে পান্ডাগিরি করে কোনও মতে দিন চালান। ভীম বলেন, ‘‘আন্দোলনের সময় যারা বেইমানি করেছে তারাই এখন করে খাচ্ছে।”
ভীমের মতোই তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সংঘাত থেকেই গেরুয়া শিবির আঁকড়ে ধরেছেন গৌতম মাহাত, শান্তনু দে-রা। রাজ্য গোয়েন্দা দফতরের খাতায় যাঁদের পরিচয় মাওবাদী সংগঠক হিসাবে। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘জঙ্গলমহলে এখন মাওবাদীরা নেই। তৃণমূলের দাবি চার দিকে উন্নয়নের জোয়ার। তা হলে এক জন নেতাও রাতে নিজেদের বাড়ি থাকেন না কেন? তাঁদের পুলিশের নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে গ্রামে ঘুরতে হয় কেন? সবাই হয় মেদিনীপুর নয়তো ঝাড়গ্রামে থাকেন কেন?”
আরও পড়ুন, এ এক অন্য অযোধ্যা, ভোপালের ভোটযুদ্ধে প্রজ্ঞার সঙ্গেই হিন্দুত্বের নৌকায় দিগ্বিজয়
কথাটা যে মিথ্যে নয় তার ইঙ্গিত মিলল শ্যামল মাহাতর কথায়। পঞ্চায়েতে শাসক দলের ভরাডুবির পর বিনপুর-১ (লালগড়) ব্লকের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শ্যামলকে। কিন্তু এখনও শ্যামলের পরিচিতি লালগড় আন্দোলনের পোস্টার বয় ছত্রধর মাহাতর ছায়াসঙ্গী হিসাবে। বীরকাঁড়ে সেই পুরনো মেটে বাড়িতেই দেখা মিলল শ্যামলের। ভোটের প্রসঙ্গ উঠতেই শ্যামল বলেন, ‘‘আশা করছি, আমার ব্লক থেকে তৃণমূলকে ভাল লিড দিতে পারব।” বাকি এলাকা এবং চূড়ামণি মাহাত থেকে শুরু করে শ্রীকান্ত মাহাতদের মতো অন্য নেতাদের কথা উঠতেই এড়িয়ে গেলেন শ্যামল। তবে জানাতে ভোলেননি যে, তিনি রাতে এই বাড়িতেই থাকেন এবং তাঁর কোনও নিরাপত্তারক্ষীও নেই। তিনি বলেন, ‘‘আমি এমন কিছু করিনি যে, আমাকে নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে ঘুরতে হবে।” শ্যামলের মন্তব্য যে খুব সচেতন ভাবেই করা, তা বেশ স্পষ্ট।
ঝাড়গ্রামের বাম প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রমকে নিয়ে পদযাত্রা বৃন্দা কারাটের।— নিজস্ব চিত্র।
শ্যামলের বাড়ি থেকে বেরতেই দেখা শালবনীর ভীমপুরের এক তৃণমূল নেতার সঙ্গে। তাঁর কাছে জানা গেল, তাঁদের বিধায়ক শ্রীকান্ত মাহাত নির্বাচন নিয়ে খুব ব্যস্ত। তবে নিজের এলাকায় নয়। জামশেদপুরে। সেখানে তাঁর স্ত্রী তৃণমূলের প্রার্থী।
গোটা ঝাড়গ্রাম জুড়েই ছবিটা অনেকটা একই রকম। অনেকে নেই। অনেকে আবার আছেন; অথচ থেকেও যেন নেই। বিনপুর, বেলপাহাড়ি, জামবনি, গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম থেকে বান্দোয়ান— এক একটা বিচ্ছিন্ন অংশ। পুরনো এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘জেলায় এমন কোনও নেতা নেই যিনি সব ক’টা ব্লক-অঞ্চলের নেতাদের একজোট করে চলতে পারেন।”
পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকে সেই ‘জেলা-নেতা’র ভূমিকাই পালন করে চলেছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। গোটা জেলা তিনি চষে বেড়াচ্ছেন এই বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে এক সুতোয় বাঁধতে। সেই প্রসঙ্গেই জনগণের কমিটি থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া এক নেতা বলে ফেললেন, ‘‘আসলে গোড়া থেকেই জঙ্গলমহলে দল পরিচালিত হয়েছে কলকাতা থেকে। শুরুর দিকে শুভেন্দু অধিকারী। তার পর মুকুল রায়। আর এখন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এঁরাই জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই দক্ষ জেলা নেতার জন্ম হয়নি!”
লালগড় আন্দোলনের সময় ছত্রধর। তাঁকে ঝাড়গ্রামে তৃণমূলের সংগঠকের দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন দলনেত্রী।— ফাইল চিত্র।
সেই খামতিটা বুঝেই গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের আগে শুরু হয়েছিল ছত্রধর মাহাতকে জেলমুক্ত করার প্রয়াস। লালগড় আন্দোলনের সময়ে ছত্রধরের ঘনিষ্ঠ এক সঙ্গী এসআই চকে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘গত বছর গোড়ার দিকে কসবায় শুভেন্দু অধিকারীর অফিসে যাই। ওই দিনই শুভেন্দুদা নবান্নে নিয়ে যান, দিদির কাছে। দিদি রাজীব কুমারকে দায়িত্ব দেন ছত্রধরের জামিন করানোর।” এর পর বছর ঘুরে গিয়েছে। কারা দফতরের নথি বলছে, ওই সময় থেকে ছ’বারের বেশি প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন ছত্রধর। জেলের থেকে বেশি সময় কেটেছে মুকুন্দপুরের গেস্টহাউসে বা এসএসকেএমের অভিজাত উডবার্ন ওয়ার্ডের কেবিনে। কিন্তু জামিন এখনও হয়নি।
আরও পড়ুন, প্রধানমন্ত্রীকে জেতানোর গর্বেই ভাসছে বারাণসী, মন্ত্র এখন ‘নমামি নমো’
লালগড়ের এক তৃণমূল নেতা স্বীকার করেন, ‘‘পরিকল্পনা ছিল ছত্রধরকে জেলা তৃণমূলে সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হবে।” গত দেড় বছরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণও। ছত্রধরের ঘনিষ্ঠরা জানেন, শুভেন্দু নন, এখন ছত্রধরের মেন্টর পার্থ চট্টোপাধ্যায়। যাঁরা এক সময়ে লালগড় থেকে উদ্যোগী হয়েছিলেন ছত্রধরকে জেলমুক্ত করতে, তাঁদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে ‘শহুরে’ ছত্রধরের। শ্যামলের মতো ছত্রধর ঘনিষ্ঠদের প্রশ্ন করলেও ছোট্ট জবাব— ‘‘আমি ঠিক জানি না কলকাতায় কী হচ্ছে।” সব শুনে কাঁটাপাহাড়ির এক তৃণমূল কর্মীর সহাস্য মন্তব্য, ‘‘আরে বাবা, এখন ছত্রদা নিজেও তো করে খাওয়াদের দলে।”
জঙ্গলমহলের শালবনের আঁকেবাঁকে ভেসে বেড়ায় ভীমের কথার রেশ, ‘‘বিজেপি তো পরোক্ষ। লড়াইটা করে খাওয়াদের বিরুদ্ধে। ওদের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে।” আর তাই শ্যামলের মতো তৃণমূলের নেতাদের ভরসা সেই লাল পতাকা, ‘‘সিপিএমের পুরনো লোকজন অনেক দিন পর মিছিলে মিটিঙে যাচ্ছে। আমাদের পক্ষে শুভ লক্ষণ।”
(দুই চব্বিশ পরগনা, হাওড়া ও হুগলি, নদিয়া-মুর্শিদাবাদ, সহ দক্ষিণবঙ্গের খবর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা খবর, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের খবর পেয়ে জান আমাদের রাজ্য বিভাগে।)