Lok Sabha Election 2019

‘শেষপুরে’র পরম্পরা শেষ হয়নি আজও

বাংলায় লোকসভা ভোটের ষষ্ঠ দফায় দিনভর হিংসা, অশান্তি, উত্তেজনার খবর ভেসে আসছিল যখন, স্মৃতির নোটবুকের পাতা উল্টোতে গিয়ে বেরিয়ে এল পুচন দলুই, নিমাই শী-দের মুখ।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৯ ০৩:১২
Share:

বাংলায় লোকসভা ভোটের ষষ্ঠ দফায় দিনভর চলল হিংসা, অশান্তি, উত্তেজনা। ছবি: পিটিআই।

বাজারে জিলিপির দোকানটা আজও আছে। যে সে জিলিপি নয়। মুগের জিলিপি! স্বাদ মুখে লেগে আছে। স্মৃতিগুলোও।

Advertisement

স্মৃতি অবশ্য জিলিপির মতো মিষ্টি নয়। বরং, হিংসার আঁচে পোড়া। স্বজন হারানো মানুষের যন্ত্রণায় ভারী।

বাংলায় লোকসভা ভোটের ষষ্ঠ দফায় দিনভর হিংসা, অশান্তি, উত্তেজনার খবর ভেসে আসছিল যখন, স্মৃতির নোটবুকের পাতা উল্টোতে গিয়ে বেরিয়ে এল পুচন দলুই, নিমাই শী-দের মুখ। বাংলার রাজনৈতিক সংঘর্যের ইতিহাসে বরাবরই মোটা অক্ষরে নাম থেকেছে মেদিনীপুরের এই জনপদের। কখনও এ দল, কখনও ও দলের দাপটে ত্রস্ত থেকেছে বাকি রাজনৈতিক দল এবং আম জনতা।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নোটবুকের পাতা ধরেই যদি ফিরে যাওয়া হয় অতীতে, উঠে আসবে সেই বিখ্যাত স্লোগান— ‘কেশপুর, সিপিএমের শেষপুর’! উঠে আসবে ‘পাঁশকুড়া লাইন’। গীতা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে অধুনালুপ্ত পাঁশকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সিপিআইয়ের প্রার্থী গুরুদাস দাশগুপ্তকে রাস্তায় ধরে হেনস্থা করার ছবি। তৃণমূলের টিকিটে কলকাতা বন্দরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিক্রম সরকারের জয়ে ‘পাঁশকুড়া লাইন’-এর প্রবল প্রতিষ্ঠা। আবার এক বছরের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের নন্দরানি ডলের এক লক্ষ ৮ হাজার ভোটে জয়ে যে লাইনের তখনকার মতো বিসর্জন!

রেকর্ডের বই বলছে, ক্ষমতায় যারা থাকে, কেশপুর সাধারণত থাকে সে দিকেই। রজনী দলুই, হিমাংশু কুমার, নন্দরানি হয়ে এখন শিউলি পর্যন্ত একই ধারার আবর্তন। নতুন দল তৈরির কয়েক মাসের মধ্যে এই চাকা ঘোরানোর চেষ্টা করেছিল তৃণমূল। সেই ১৯৯৮ সালের জুন-জুলাই থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কেশপুরের দখল নিয়েছিল তারা। মহেন্দ্র দলুই-সহ পাঁচ সিপিএম সমর্থকের খুন হওয়ার ঘটনা দিয়ে মোটামুটি যে দখলদারির সূত্রপাত। কয়েক বছর পরেও মধুপুর গ্রামে সেই বাড়ি এবং বাবার খুন হওয়ার দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন মহেন্দ্রের কন্যা পুচন। তার মধ্যেও শক্ত চোয়ালে একটা কথাই ছিল— ‘‘ভোটটা সিপিএমকেই দেব!’’ সিপিএমের অভিযোগ, ওই সময়ে তাদের ৬৭ জন কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছিলেন।

পাঁশকুড়ার সেই উপনির্বাচনের সিপিআই প্রার্থী গুরুদাসবাবু মনে করতে পারেন, ‘‘খুব অত্যাচার আর অসভ্যতা হয়েছিল সে বার। রাস্তায় আমাকে হেনস্থা, আক্রমণ করেছিল। চার বছর পরে আবার সেই আসন থেকেই আমরা যখন জিতলাম, তখন সব শান্ত।’’ কংগ্রেসের হয়ে সেই উপনির্বাচনে লড়েছিলেন শুভঙ্কর সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘প্রণবদা’কে (মুখোপাধ্যায়) পর্যন্ত সভা করতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। হামলা, মারদাঙ্গার মধ্যে লড়ে গিয়েছিলাম। সে সব বিষবৃক্ষের ফল আজও ফলছে!’’

কেশপুরের সেই পর্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতি ছিলেন মহম্মদ রফিক। ‘পাঁশকুড়া লাইন’ করে তিনি এমনই ‘হিরো’ হয়ে উঠেছিলেন, কলকাতা পুরসভার ভোটে তাঁর সভার চাহিদা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় তাঁর দলনেত্রীর কাছাকাছিই! কিন্তু পাঁশকুড়ার সাফল্যের ‘উদযাপন’ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বছরখানেকের মধ্যেই কেশপুর পুনর্দখল করেছিল সিপিএম। সেই রফিকই আনন্দপুরে দেখিয়েছিলেন অমিত ঘোষের বাড়িটা। যার সামনে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওই তৃণমূল সমর্থকের দেহ। রফিকের দাবি ছিল, ‘‘আমাদেরও ৬৫ জন খুন হয়েছে কেশপুরে। অনেকের দেহটাও লোপাট হয়েছে। মানুষ এ সব মানবে না!’’

মার খেয়ে, ঘরছাড়া হয়ে পিছু হটার পরেও ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের নন্দরানি তৃতীয় বারের জন্য জিতে এসেছিলেন, সে বার লক্ষাধিক ভোটে! মহাবিতর্ক উঠেছিল এমন দুস্তর ব্যবধানে জয় নিয়ে। সেই জয় তাঁকে মন্ত্রী করে ছিল। এলাকার মানুষ বলতেন, তৃণমূলের সঙ্গে সংঘর্ষে অভিভাবক হারানো শ’খানেক শিশুর জন্য আশ্রম তৈরি করেছিলেন নন্দরানি। আশ্রয় দিতেন ঘরছাড়াদের। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার পরে নিজে এলেন কেশপুরে। বেশ কিছু স্কুলের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অনুমোদন হল, সেজে উঠল কলেজ। হিংসার বৃত্ত থেকে কেশপুরকে বার করে আনার একটা চেষ্টা বুদ্ধবাবুর ছিল। এবং উল্লেখ থাকা উচিত, পরের ভোটে নন্দরানি আর টিকিট পাননি! এবং আরও উল্লেখ্য, তিন বছর আগের বিধানসভায় তৃণমূলের শিউলিও জিতেছেন লক্ষাধিক ভোটে।

ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে ঘাসফুল ফুটে থাকা আজকের কেশপুরে সংঘর্ষ কেন? কেশপুরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক রামেশ্বর দলুই বলছেন, ‘‘যে-ই জিতুক, বিরোধীদের ভোট তো থাকে। জোর করে তাকে অস্বীকার করার পরিণাম ভাল হয় না। বাঁচার রাস্তা খুঁজতে তৃণমূল এবং বামেদের একটা অংশ বিজেপিকে ধরেছেন।’’ আদালতের ছাড়পত্র নিয়ে গড়বেতায় রবিবার ভোট দিয়ে সেখানকার প্রাক্তন বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ বলছেন, ‘‘এখন তো সিপিএম নেই! কেন গোলমাল, তার উত্তর আমরা কী ভাবে দেব?’’ আর রাজ্যের মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য, ‘‘গোলমাল তো নেই! ভারতী ঘোষের হুমকি, প্ররোচনার কিছু প্রতিবাদ মানুষ করেছেন শুধু।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement