ভোটের লাইনে মৌসুমী কয়াল। রবিবার, কামদুনিতে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
ছ’বছরেও বদল হয়নি আটবিঘা জমিটার। লোহার দরজা পেরিয়ে পাঁচিলে ঘেরা জায়গাটায় এখন বুক পর্যন্ত লম্বা ঘাস। একপাশে ভাঙা পাঁচিল, অন্য পাশে দরজা জানলা ভাঙা দু’টো ঘর। তারই একটা দেখিয়ে জমির কেয়ারটেকার বললেন, “এ ঘরেই পা চিরে মেয়েটাকে খুন করা হয়েছিল।”
আটবিঘা জমি থেকে গণধর্ষণের পরে খুন হওয়া কামদুনির মেয়েটির বাড়ি হাঁটাপথে মেরেকেটে কুড়ি মিনিট। গত ছ’বছরে পাঁচিলে ঘেরা জমিটি না বদলালেও অনেকটাই বদলেছে কামদুনি এলাকা। রাস্তার ধারে বাতিস্তম্ভ। রাজ্যের শাসক দলের পাশাপাশি, ইতিউতি লাগানো বিজেপির পোস্টার। কামদুনিতে এখন আর থাকেন না ধর্ষিতার মা-বাবাও। পরিবারের তিন জন রাজ্য সরকারের দেওয়া চাকরি পাওয়ার পরে তাঁরা উঠে গিয়েছেন অন্যত্র।
তবু ভোট দিতে রবিবার কামদুনি ফিরে ধর্ষিতার ছোট ভাই বললেন, “আমরা তো বেঁচেও মরে রয়েছি। চাকরি পেলেও স্থায়ী চাকরি এখনও হয়নি।”
ভোট কাকে দেবেন? বছর সাতাশের ওই যুবকের উত্তর, “দিদিকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল। এরকমই তো ঘটেছিল পার্ক স্ট্রিটে। এ বারের এক তৃণমূল প্রার্থী তো শুনেছি সেই ঘটনায় জড়িতদের সাহায্য করেছিলেন।”
রবিবার রাজ্যের সপ্তম দফা নির্বাচনের দিন ভোট হয়েছে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের কামদুনিতে। সকাল থেকেই বুথ চত্বর ঘুরে দেখা গেল, ছ’বছর আগের সেই গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনা আজও টাটকা ভোটারদের মনে। ধর্ষিতার ভাই তো বলেই দিলেন, এখনও কামদুনিতে ভোট হয় ওই ধর্ষণের ঘটনাকে মনে রেখেই। তিনি জানান, ২০১৩ সালের ৭ জুন, সেই দিনে কলেজফেরত দিদিকে আনতে কামদুনি মোড়ে গিয়েছিলেন তিনি। প্রবল বৃষ্টিতে দিদিকে খুঁজে না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। পরে রাত ৮টা নাগাদ খবর পান, আটবিঘা জমির পাঁচিলের বাইরে এক তরুণীর ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে রয়েছে।
এটুকু বলে অবশ্য আর কথা এগোতে পারেন না তরুণ। ছেলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ধর্ষিতার বাবা বলেন, “কোনও আইবুড়ো মেয়ের বিয়ে দেখলে, রাখী পূর্ণিমার দিনে, দুর্গাপুজো এলে আমাদের খুব কষ্ট হয়। ও চাউমিন খেতে ভালবাসত। আমরা কেউ আর চাউমিন খাই না।”
ধর্ষিতার পাশে দাঁড়িয়ে সেই সময়ে আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠা মৌসুমী কয়াল এবং টুম্পা কয়ালের মনেও এখনও ছ’বছর আগের স্মৃতি। সকাল সকাল ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে মৌসুমী বলেন, “দৃশ্যটা চোখের সামনে এখনও ভাসে। ও ভাবে যে কেউ কাউকে শেষ করতে পারে, ভাবতে পারি না। ফিরে এসে লাল আলতায় ‘বিচার চাই’ লিখে রাস্তায় নেমে পড়েছিলাম। আমাদের একটাই দাবি ছিল, মুখ্যমন্ত্রী এসে দেখে যান।” ঘটনার ১০ দিনেরও বেশি পেরিয়ে যাওয়ার পরে কামদুনিতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে সে দিন যা হয়েছিল, তার দরকার ছিল না বলে মনে করেন মৌসুমী-টুম্পারা। মৌসুমীর কথায়, “কলেজে পড়ার সময় থেকে দেখেছি, দিদি কেমন লড়াই করেন। সেই সময় থেকেই দিদির ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম। তিনিই আমাদের প্রেরণা ছিলেন। কিন্তু তিনি এসে যা করলেন! দু’মিনিট দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনলেই তো মিটে যেত।” কামদুনির এক বিদ্যালয়ে ভোটের লাইন ঠিক করতে ব্যস্ত কেন্দ্রীয় বাহিনীর দিকে তাকিয়ে মৌসুমী বলে চলেন, “সরকার বা সরকারের লোক আমাদের স্বার্থে। আমরা ওদের স্বার্থে নয়।” টুম্পা অবশ্য বিয়ের পর নিউ টাউনে উঠে গিয়েছেন। ফোনে তিনি বলেন, “মেয়েটার সঙ্গে যা হয়েছিল, তা সারা জীবনেও ভুলব না।”
বাবাকে নিয়ে এ দিন মোটরবাইকে ওই বুথেই ভোট দিতে যাচ্ছিলেন ধর্ষিতার ভাই। যাওয়ার পথে তিনিও বলছিলেন, “দিদির সঙ্গে যা হয়েছে, তা ভোলা যায় না। তবু এ বার ভোট দেব উন্নয়নের স্বার্থে। মুখ্যমন্ত্রী সাইকেল দিয়েছেন, কন্যাশ্রী প্রকল্প করেছেন। আমার দিদি বেঁচে থাকলে হয়তো সে-ও আজ কোনও না কোনও সরকারি সাহায্য পেত।”