ভাঙচুর হওয়া আনন্দবাজার পত্রিকার গাড়ি। রবিবার কেশপুরে। নিজস্ব চিত্র
কেশপুর থানার সেরেস্তায় অসহায়ের মতো বসে আছেন ভারতী ঘোষ। কিছু ক্ষণ আগে থানার চৌহদ্দির ঠিক বাইরে যে কালীমন্দিরে ধর্নায় বসেছিলেন সেখানে ইটবৃষ্টি হয়েছে। অগত্যা মন্দিরের পাঁচিল টপকে এসে থানাই তখন তাঁর আশ্রয়স্থল। সঙ্গে গাড়ি নেই। পুলিশ তা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। তাই রক্ষীদের গাড়িতেই কেশপুর থেকে শেষপর্যন্ত বেরিয়ে যেতে রাজি হয়েছেন ঘাটাল কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী। রাজি হতেই পুলিশি ব্যবস্থা পূর্ণ, হুশ হুশ করে বেরিয়ে গেল প্রাক্তন ‘এসপি ম্যাডাম’-এর কনভয়। আগের মতো নয়। ওই কনভয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা ছাড়া বাকি সবই সংবাদমাধ্যমের গাড়ি।
গোলমালের মধ্যে পড়ে আমাদের গাড়িটি একটু দূরে সরে গিয়েছিল। তাকে খুঁজে নিয়ে আমরাও চলতে শুরু করলাম ভারতীকে ধরার জন্য।
প্রথমে জেনেছিলাম, তিনি গিয়েছেন মেদিনীপুরের দিকে। পরে জানলাম, মেদিনীপুর নয়, রাউতা বাজার থেকে ফের কেশপুরের অন্দরে ঢুকছেন ভারতী ঘোষ। রবিবারের প্রথম অর্ধে ষষ্ঠীর ভোটে এত ক্ষণ যা হয়েছে তার পর আবার কেশপুরের প্রত্যন্ত এলাকায়! আমরাও চলি রাউতা বাজার পেরিয়ে ঝেঁতলার দিকে। কারণ, ভারতী সেখানে ভোট দেখতে গিয়েছেন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আড়াইটে নাগাদ ঠিক ঝেঁতলা বিদ্যালয়ের মুখে আমরা পৌঁছয়। সবার পিছনে আমাদের গাড়ি। হঠাৎ দেখি আগের গাড়িগুলো দ্রুত মুখ ঘোরাতে শুরু করেছে। আমাদের ফোটোগ্রাফার বিশ্বনাথ বণিক গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়, যদি কিছু ছবি হয়। গাড়ি ঘুরিয়ে সবে এগিয়ে আসছি। হঠাৎ দেখি উল্টোদিক থেকে রে রে করে তেড়ে আসছে মারমুখী কয়েক জন। তাদের হাতে আধলা ইট আর রেললাইনের পাথর। ডান দিক-বাঁ দিকে চোখ যেতেই দেখি দু’পাশের ধানক্ষেত থেকেও এগিয়ে আসছে বেশ কয়েক জন। বুঝি, ফেঁসে গিয়েছি পুরো। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি। আর বারবার চেষ্টা করছি বিশ্বনাথকে ফোনে ধরার, যাতে ও অন্য কোনও গাড়িতে উঠে পরে। বসেছিলাম পিছনের সিটে চালকের ঠিক পিছনে। মুহূর্তে দেখলাম, বাঁদিকের পিছনের দরজার কাচ ঝুরঝুর করে পড়ল সিটের উপর। সঙ্গে একটা পাথরও এসে পড়ল আমার পায়ে। আমি বুঝলাম বিপদ। আমনকে বললাম, কোনও দিকে দেখবে না। সোজা গাড়ি চালাও। বিকট শব্দ শুনে পিছনের দিকে তাকাতেই দেখি ইটের টুকরো ডিকির উপরে পড়ে রয়েছে। আর অপেক্ষা না করে আমি সামনের ও পিছনের সিটের মধ্যবর্তী অংশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। দু’হাত মাথার পিছনে রাখলাম রক্ষাকবচ হিসাবে। এবার ডানদিকে পিছনের দরজার কাচও ভেঙে পড়ল। পিঠে এসে পড়ল একটা মস্ত ইট। আমি আর মাথা তুলছি না। শুধু চিৎকার করে আমনকে বলছি, গাড়ি থামিও না। যেভাবে পারো বেরিয়ে যাও। তখনও ধুপধাপ ইট পড়ছেৃ। জানলায় ধাক্কা খেয়ে আমার পিঠে, গায়ে তা এসে পড়ছে। ঝেঁতলা মোড় থেকে বাঁদিকে মিনিট খানেক যাওয়ার পরে দেখি আর কোনও শব্দ নেই। চালককে জিজ্ঞাসা করলাম, আর কিছু হয়নি তো। কাউকে দেখছ? ও বলল, না।
আমি দুই সিটের মধ্যবর্তী অংশ থেকে ওঠা মাত্র নিজের হাত দেখে চমকে উঠি। দেখি, দু’হাত বেয়ে অঝোরে রক্ত পড়ছে। এতক্ষণ কাচের ওপরে দু’হাত পেতেই তো উপুড় হয়ে শুয়েছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য যেন কথাই বলতে পারছিলাম না। আমন নিজের মতোই গাড়ি চালাচ্ছে। নির্বিকার। ফোন করলাম, বিশ্বনাথকে। না পাওয়া গেল না। এরপর রাজ্য পুলিশের এক কর্তাকে পুরো ঘটনা জানিয়ে দ্রুত কিছু করার আর্জি জানালাম। কারণ, আমি কোনও ক্রমে বেরিয়ে আসতে পারলেও ঝেঁতলায় আটকে তখন আমার সহকর্মীরা। জানালাম অফিসেও।
এবার ভাবছি বেরিয়ে তো এলাম, কিন্তু যাচ্ছি কোথায়? এই রাস্তায় তো আগে কখনও আসিনি। যেভাবে হোক ঘাটাল অথবা বম্বে রোডে গিয়ে পড়তে হবে। ঝেঁতলা পেরিয়ে এলাম বিশ্বনাথপুরে। সামনে দেখি তৃণমূলের এক ক্যাম্প অফিস। তখন ভয়ে পুরো সিঁটিয়ে গিয়েছি। সাহস বাড়াল পিছনের দু’টি সংবাদমাধ্যমের গাড়ি। তাদের উপরেও ইট-পাথরের বৃষ্টি হয়েছে। ক্যাম্পের সামনে আসতেই জন পঞ্চাশেক ছেলে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। আমার দুই রক্তমাখা হাত ও আমাদের গাড়ির অবস্থা দেখে বোধহয় মায়া হল। ঘটনা জানাতেই বলল, ‘সকাল থেকে শুধু ভারতী-ভারতী করছেন। কেশপুরের মানুষ মানবেনি’।
এরপর এক যুবক এগিয়ে এসে বললেন, ‘চলুন আমি আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসব। দেখি কে গায়ে হাত দেয়?’ একটি বাইকে দুই সওয়ার আমাদের গাড়ির সামনে যেতে থাকলেন। ভয়ও পাচ্ছি। নতুন কোনও ফাঁদে পড়ছি না তো! ক্রমে জয়হরিচক, বৃন্দাবনপুর, কাঁসাইয়ের বাঁধ, এমনকী কাঁসাই নদীর উপর বাঁশের সাঁকো পার করে তাঁরা আমাদের বম্বে রোডে পৌঁছে দিলেন দীপক দলুই, শরদিন্দু মাইতি নামে বাইকে সওয়ার ওই দুই যুবক। তা না হলে কেশপুরের গোলক ধাঁধায় কী যে হত জানি না!
এখানেই শেষ নয়। মাঝখানে বারবার কথা বলেছি, আমাদের ফটোগ্রাফার বিশ্বনাথের সঙ্গে। ওর উপর দিয়েও যা গিয়েছে তা কম নয়। আধলা ইট তুলে ওকে মারতে উঠেছিল একদল লোক। হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা করে এবিপি আনন্দের গাড়িতে উঠে যায় বিশ্বনাথ। তারপর সেখানে থাকা সব সংবাদমাধ্যমের গাড়ি ঘিরেই শুরু হয় বোমাবাজি। সঙ্গে ইট-পাথর। পরে যখন দেখা হয় বিশ্বনাথ জানায়, গুলি চলার শব্দও শুনেছিল। আর যারা বোমাবাজি করছিল তারা কথা বলছিল হিন্দিতে। সঙ্গে ভারতীর নামে গালিগালাজ। এই পুরো পর্বে পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী, ক্যুইক রিঅ্যাকশন টিম, পর্যবেক্ষক, পুলিশ পর্যবেক্ষক, সেক্টর অফিসার, মাইক্রো অবজারভার— কারও দেখা মেলেনি! সন্ধ্যায় কলকাতার অফিসে ফিরে শুনলাম নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভোট ‘ভেরি পিসফুল’।