দার্জিলিঙের রাস্তায় পর্যটকদের ভিড়। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
এখানে ভোট আছে নাকি? কবে? দার্জিলিং ম্যালে ঘুরতে ঘুরতে এই প্রশ্নটাই বারবার উঠে এল। সপ্তাহান্তের ম্যালে তখন পা রাখার জায়গা নেই।
জায়গা নেই হোটেলেও। তা সে সরকারি টুরিস্ট লজ হোক, বা বেসরকারি হোটেল। এপ্রিল তো কোন ছাড়, মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সর্বত্র ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই।
কিন্তু ১৮ এপ্রিল? সে দিন তো ভোট রয়েছে পাহাড়ে। টুরিস্ট লজের কর্মী তালিকা দেখে জানালেন, নাহ, সে দিনও কোনও ঘর ফাঁকা নেই।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
তা হলে কি বদলে গেল দার্জিলিং? ভোটের আগে টানটান উত্তেজনা, ভোটে দিন গোলমাল হওয়ার আশঙ্কার কথা আর উঠছে না? দার্জিলিঙের অনেক মানুষ অবশ্য বলছেন, ভোটের দিন তেমন কোনও গোলমালের স্মাপ্রতিক ইতিহাস নেই। কারণ, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ঘিসিং বা গুরুংম-ই ছিলেন পাহাড়ে শেষ কথা। তখন তাঁদের উল্টোপথে গিয়ে কেউ গোলমাল করার সাহস পেত না।
কিন্তু ভোটের সময় না হলেও, দেড় বছর আগের সেই ২০১৭ সালের ৮ জুনের গোলমালের কথা কি পাহাড় ভুলে গেল? যার পরে বিমল গুরুং ফতোয়া দেন, ১০ তারিখের মধ্যে পাহাড় ছেড়ে চলে যান সব পর্যটক। পরে কোনও ক্ষতি হলে, দায় তাঁদের নয়। তখনও পাহাড়ে থেকে যাওয়া কলকাতার হাতে গোনা পর্যটক রাত বারোটায় গাড়ি নিয়ে রওনা দেন সমতলের উদ্দেশে। দ্বিগুণ ভাড়া গুণতে হয়েছিল। বাচ্চাকাচ্চা সঙ্গে নিয়ে কী ভাবে নেমে এসে রাত তিনটে নাগাদ শিলিগুড়ির হোটেলে উঠেছিলেন তাঁরা, সে এখন ইতিহাস। এখন পাহা্ড়ে ঘুরতে ঘুরতে মনে হল, সেই গন্ডগোলকে অনেকটা পিছনে ফেলে এসেছে দার্জিলিং।
আবার, ২০০৯ সালের মে মাসের শেষে যে দিন বিজেপি সাংসদ যশোবন্ত সিংহকে ম্যালে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন বিমল, সে দিন ছিল অঘোষিত বন্ধ। ম্যালের চারধারে পা রাখার জায়গা নেই। গুরুংয়ের নেপালিতে ভাষণের সঙ্গে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি উঠছিল। এই ক’বছরে তা হলে পুরো বদলে গেল দার্জিলিং, গুরুংয়ের খাসতালুক?
নাম প্রকাশ করতে চান না, এমন কয়েক জন দোকানদার বললেন, ‘‘সকলেই শান্তিতে ব্যবসা করতে চায়। এখন সেটাই হচ্ছে।’’ কিন্তু সামনে যে ভোট? তাঁদেরই কেউ কেউ বললেন, ‘‘যা ক্ষতি হওয়ার আগেই হয়ে গিয়েছে। ভোটের জন্য আর তাই ব্যবসার লোকসান করতে চাই না। ভোট হোক ভোটের মতো। আমরা আমাদের দোকান খোলা রাখব।’’
সরাসরি না বললেও এর কৃতিত্ব রাজ্য সরকার এবং বর্তমান জিটিএ-কে দিচ্ছেন দোকানদারদের বড় অংশ। একই কথা বলছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন হিমালয়ান হসপিট্যালিটি অ্যান্ড টুরিজম ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক। তাদের সাধারণ সম্পাদক সম্রাট সান্যাল বলেন, ‘‘শান্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে রাজ্য সরকারের ভূমিকাও ভাল। মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে তারা প্রচার করেছে। তাই এ বারে শুধু দেশি নয়, প্রচুর বিদেশি পর্যটকও এসেছেন পাহাড়ে। ভোটের প্রভাব এখন অবধি পর্যটকদের মধ্যে তেমন নেই।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এ বারে বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর পর্যটক এসেছেন।’’
ম্যালে সকাল-সন্ধ্যা এক চক্কর ঘুরলেই ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যায়। ম্যালের ধারের যে চেয়ারে সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে এসে বসেছিলেন হরিধন, সেখানে এখন বসার জায়গা মিলবে না।
বরং ভিড়ের মধ্যে কখনও মেয়েলি কণ্ঠে আব্দার, ‘‘আইসক্রিম খাওয়াইবা না!’’ সঙ্গে সঙ্গে জবাব পুরুষ কণ্ঠে, ‘‘দোকান পাইলে তো!’’
এ সব মিলেমিশে দিব্যি তরতাজা দার্জিলিং। মেঘ-রোদের খেলার মাঝেও। মেঘের দিকে তাকিয়ে এক পর্যটক গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন, ‘মেঘ বলেছে যাব, যাব’।
সত্যিই কি যাবে মেঘ? পাহাড়ের মানুষ এখন সেই প্রশ্নেরই জবাব খুঁজছেন। যদিও জবাব আছে তাঁদের মনের মধ্যেই।