মমতাজ সংঘমিতার নামটা শুনে প্রথমে যেন চিনতেই পারলেন না! ‘‘কে তিনি?’’ নিষ্পাপ ভঙ্গিতে প্রশ্ন সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়ার।
মমতাজ সংঘমিতা, আপনার প্রতিপক্ষ, এখানকার সাংসদ! মনে করিয়ে দিতে হল একটু বিস্ময় প্রকাশের ভঙ্গিতেই। তাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত ও নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘ও আচ্ছা।’’
শুধু এইটুকু প্রতিক্রিয়ায় চলবে কী ভাবে? বাংলা থেকে নির্বাচিত সাংসদ হিসেবে মোদী সরকারে মন্ত্রিত্ব করলেন এত দিন, শিল্পনগরীর পুনরুজ্জীবনের জন্য কী করলেন? শুধু বিদায়ী সাংসদ সংঘমিতা নন, সিপিএম প্রার্থী আভাস রায়চৌধুরীও তো একই প্রশ্ন করছেন। বর্ধমান-দুর্গাপুর থেকে যখন লড়ছেন এ বার, তখন এ প্রশ্ন এড়াবেন কী ভাবে?
মেজাজ একটুও বিগড়োল না অহলুওয়ালিয়ার। ঠান্ডা মাথার শিক্ষক যে ভাবে পড়ান ক্লাসে, ঠিক সে ভাবেই বোঝাতে লাগলেন হিন্দুস্তান ফার্টিলাইজার (এইচএফসি) বা এমএএমসি-র মতো বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পুনরুজ্জীবনে কতটা ‘সচেষ্ট’ কেন্দ্রীয় সরকার এবং কতটা ‘অসহযোগিতা’ রাজ্য সরকার করে চলেছে।
বেনাচিতি গুরুদ্বারের সামনে বসে মমতাজ সংঘমিতা কিন্তু ঠিক উল্টোটাই বলেছেন। দুর্গাপুরের স্বার্থে বা বাংলায় শিল্পায়নের স্বার্থে সংসদে বা সরকারের অন্দরে কখনও সক্রিয় হতে দেখা যায়নি অহলুওয়ালিয়াকে, অভিযোগ সংঘমিতার। ‘‘দুর্গাপুরের জন্য আমি যে সব দাবিদাওয়া নিয়ে সংসদে সরব হয়েছি, অহলুওয়ালিয়া যদি সেগুলোকে মৌখিক সমর্থনটুকুও দিতেন, তা হলেও অনেক কাজ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু উনি কোনও দিন তা করেননি। বাংলা থেকে নির্বাচিত হয়ে লোকসভায় গিয়েছেন। বাংলার জন্য এটুকু তো করতেই পারতেন। নিজে দাবি না তুলুন, আমাকে সাহায্য তো করতে পারতেন। কখনও তা করেননি,’’— কটাক্ষের ভঙ্গিতে হাসির রেখা চওড়া করে বলতে থাকেন বর্ধমান-দুর্গাপুরের বিদায়ী তৃণমূল সাংসদ।
আরও পড়ুন, জল-মুদি বন্ধ, মোদীর জন্মস্থানেই একঘরে সাত দলিত পরিবার, ভোটেও ‘টোটালি বয়কট’
আর এতেই বিস্মিত হন সিপিএম প্রার্থী আভাস রায়চৌধুরী, ‘‘উনি (সংঘমিতা) সরব হয়েছেন! সংসদে! দুর্গাপুরে শিল্পের পুনরুজ্জীবন নিয়ে! আমাদের অন্তত জানা নেই।’’ তবে রাজনৈতিক সৌজন্যের সীমারেখাটাও কিছুতেই লঙ্ঘন করতে রাজি নন আভাস। তাই বললেন, ‘‘কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে চাই না। বর্ধমান-দুর্গাপুরের বিদায়ী সাংসদ প্রায় আমার মায়ের বয়সী। বিজেপি প্রার্থীর বয়স নিশ্চিত ভাবে জানি না। তবে মনে হয় ওই একই রকম হবে। তাই কাউকেই ব্যক্তিগত ভাবে অপমান করতে চাই না। কিন্তু এ কথা সকলকে মনে করিয়ে দিতে চাই, বিজেপি নীতিগত ভাবেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর বিলগ্নীকরণের পক্ষে। এ কথা সকলকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, বাজপেয়ী জমানাতেই দুর্গাপুরে এমএএমসি বন্ধ হয়েছিল। আর তৃণমূলের তো কোনও শিল্পনীতিই নেই। তারা শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটাবেই বা কী ভাবে?’’
বাম প্রার্থী আভাস রায়চৌধুরীর ভোট প্রচার।
আভাস যে শুধু সংবাদমাধ্যমকে বলছেন এই কথাগুলো, তা কিন্তু নয়। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে এবং তার আশেপাশে আভাসের ভাষণও এ বার মূলত শিল্পায়ন বা দুর্গাপুরে শিল্পের পুনরুজ্জীবন কেন্দ্রিক। ইস্যুটা আলোচনাতেও ফিরে এসেছে দারুণ ভাবে। কিন্তু তার জেরে গোটা পরিস্থিতিটা আভাস রায়চৌধুরীর পক্ষে যাচ্ছে, এমন কিন্তু নয়। মমতাজ সংঘমিতা এবং সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া প্রায় এক সুরেই বলছেন যে, দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা হয়েছে বামফ্রন্ট জমানাতেই। সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিআইটিইউ (সিটু) শ্রমিক আন্দোলনের নামে ‘জঙ্গিপনা’ করত বলে দুর্গাপুরের কংগ্রেস-বিজেপি-তৃণমূল কর্মীরা তো দাবি করছেনই। বন্ধ হয়ে সংস্থাগুলোর কর্মীদের সঙ্গে কথা বললেও বামেদের বিরুদ্ধে উষ্মার আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছে। সিপিএম প্রার্থী শিল্পের পুনরুজ্জীবন নিয়ে কথা বলছেন শুনে ফুঁসে ওঠেন এমএএমসি থেকে স্বেচ্ছাবসর নিতে বাধ্য হওয়া অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়। বলেন, ‘‘বিকেসি-র (এক কালে দুর্গাপুরের সবচেয়ে দাপুটে সিটু নেতা বিনয়কৃষ্ণ চক্রবর্তী) দাদাগিরি কি আমরা ভুলে গিয়েছি? ঘেরাও, অবরোধ, ধর্মঘট, হুমকি, শাসানি, মারধর— ব্যতিব্যস্ত করে রাখতেন গোটা সংস্থাটাকে। দুর্গাপুরের একের পর এক কারখানায় কত কর্মদিবস এঁরা নষ্ট করেছেন জঙ্গি আন্দোলন করে, তার হিসেব করা হলে এঁদের কথা বলার মুখ থাকবে তো?’’
কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে প্রচারে বেরিয়েছেন সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া।
অর্থাৎ, দুর্গাপুরে শিল্পের পুনরুজ্জীবনকে অন্যতম প্রধান নির্বাচনী ইস্যু করে তোলার চেষ্টা যিনি করছেন, অভিযোগের তির কিন্তু তাঁর দলের দিকেই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরছে। জবাবে কী বলছেন এককালের দাপুটে যুবনেতা? কাঁকসায় প্রচারের ফাঁকে তিনি বলছেন, ‘‘বামফ্রন্ট সরকারের উপরে দোষ চাপিয়ে দিয়েই সবাই রেহাই পেয়ে যাবেন! সে সময়ে শুধু বাংলায় নয়, গোটা পূর্ব ভারতে শিল্পের সর্বনাশ ঘটেছিল এবং সেটা ঘটেছিল কেন্দ্রীয় সরকারের মাশুল সমীকরণ নীতি আর লাইসেন্সিং-এর কারণে।’’ তৃণমূল আর বিজেপির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার ঢঙে সিপিএম প্রার্থী বলছেন, ‘‘শিল্পের সর্বনাশের অভিযোগ তুলে বামেদের দিকে আঙুল কারা তুলছেন? যাঁরা টাটাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়িয়ে ছাড়লেন? আঙুল কারা তুলছেন? কেন্দ্রে যাঁদের সরকার গঠিত হওয়ার পর গোটা একটা মন্ত্রক তৈরি করা হয়েছিল শুধুমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য?’’
আরও পড়ুন, মৃত্যুর ১৫ বছর পরও বেঁচে বীরাপ্পন, আছেন তামিলনাড়ুর ভোটেও
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বিলগ্নীকরণের জন্য বাজপেয়ী সরকার যে একটা গোটা মন্ত্রক তৈরি করেছিল, সে প্রসঙ্গটা মোদী সরকারের মন্ত্রী (বাজপেয়ী সরকারেরও মন্ত্রী) অহলুওয়ালিয়া এড়িয়ে যাচ্ছেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সদিচ্ছা’র খতিয়ান তুলে ধরতে চাইছেন এবং বলছেন, ‘‘গোরক্ষপুর, বারাউনি, তালচের-সহ অনেকগুলো জায়গাতেই তো এইচএফসি-র পুনরুজ্জীবন ঘটানো হয়েছে। দুর্গাপুরের এইচএফসি-ও সে ভাবেই খোলার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু যে ১৪৩ একর জমি কেন্দ্রকে হস্তান্তর করার কথা রাজ্যের, তা হস্তান্তর করা হচ্ছে না। বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনও কাজেই সহযোগিতা না করার যে নীতি নিয়ে চলছে পশ্চিমবঙ্গের সরকার, সেই নীতিই এইচএফসি নতুন করে খোলার পথে প্রধান বাধা।’’
ভোট প্রচারে মমতাজ সংঘমিতা।
অহলুওয়ালিয়ার এই অভিযোগ প্রসঙ্গে সংঘমিতা কিছু বলেন না। তবে গত পাঁচ বছরে দুর্গাপুরে শিল্পের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে যে খুব বেশি সফল হতে পারেননি, সে কথা মানতে সাংসদের আপত্তি নেই। ‘‘বুঝতেই তো পারছেন, আমরা তো কেন্দ্রীয় সরকারে ছিলাম না। তাই খুব বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না,’’—অকপট স্বীকারোক্তি প্রবীণা চিকিৎসকের।
কথোপকথন আর দীর্ঘায়িত হতে দিতে চান না ভোট প্রচারে তাঁর সর্ব ক্ষণের সহকর্মীরা। বর্ধমান শহরে কর্মসূচি রয়েছে, আর দেরি করা যাবে না— মনে করিয়ে দেওয়া হয় সাংসদকে। বিদায় জানাতে জানাতে সংঘমিতা বলে যান, ‘‘এই সব নানা কথা মাথায় রেখেই তো আমরা এ বার সরকারে আসতে চাইছি। কেন্দ্রের সরকার আমাদের হাতে এলে দুর্গাপুরের অবশ্যই লাভ হবে।’’
বর্ধমান রওনা হয়ে যান সংঘমিতা। দুর্গাপুরে রোড শোয়ের প্রস্তুতি শুরু হয় অহলুওয়ালিয়ার শিবিরে। কাঁকসায় প্রচার সেরে কোথায় যাবেন, কর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে যান আভাস। আর একের পর এক বৃহদায়তন শিল্পের সমাধির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা দুর্গাপুর বিভ্রান্ত হয়ে যায় দায় ঠেলাঠেলি দেখে। ভোটটা কাকে দেওয়া উচিত? স্থির করতে পারে না রাঢ়বঙ্গের সবচেয়ে বড় শহর।