ভোটের আগে শোভন-বৈশাখীকে দলে টানার চেষ্টা বিজেপির।
দু’বার বৈঠক হল ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে। শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় কি যোগ দিচ্ছেন বিজেপিতে? চূড়ান্ত আলোচনা সেরে নেওয়ার চেষ্টা করলেন বিজেপি নেতৃত্ব। তবে শোভনের সিদ্ধান্ত এখনও অল্পের জন্য ঝুলে থাকায় যোগদান বা দলবদলের ঘোষণা মঙ্গলবার হল না। আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন শোভন-বৈশাখী। খবর বিজেপি এবং শোভনের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের।
সোমবার রাতে আধ ঘণ্টার জন্য বিজেপি এবং সঙ্ঘের নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আড়াই ঘণ্টা গড়িয়ে সে বৈঠক শেষ হয় মধ্যরাতে। আরএসএস এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সেই বৈঠকে আলোচনা এত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মোড় নিয়েছিল যে, আজ মঙ্গলবার সূচি ভেঙে কলকাতায় চলে আসেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা অরবিন্দ মেনন। তার পরে এ দিন সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতায় কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং অরবিন্দ মেননের সঙ্গে বৈশাখীর ‘কনফিডেনশিয়াল’ বৈঠক হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করতে চেয়ে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে শনিবার সকালেই মুকুল রায় ফোন করেছিলেন। অমিত শাহের নির্দেশেই মুকুল সেই ফোন করেছিলেন বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছিল। সোমবার রাতে বিজেপি তথা সঙ্ঘের সঙ্গে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাবার্তা আরও বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। ওই বৈঠকে সঙ্ঘ এবং বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্বের প্রতিনিধিরা হাজির ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। আরএসএস-এর এক ক্ষেত্রীয় প্রচারক এবং বিজেপির এক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ কলকাতায় এসে বৈঠকটি করেন। বিজেপির এক কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক নেতাও ছিলেন। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য কোনও দলীয় কার্যালয়ে বা কোনও বিজেপি নেতার বাড়িতে যাননি। দক্ষিণ কলকাতায় বৈশাখীর পছন্দমতো একটি জায়গায় ওই বৈঠক হয়েছিল বলে খবর। আধ ঘণ্টার মতো বৈঠক হবে বলে কথা হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় শুরু হওয়া বৈঠক গড়িয়ে যায় রাত ১১টা পর্যন্ত। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কৈলাস এবং অরবিন্দের সঙ্গে ফের বৈশাখীর যে বৈঠক হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে, তা-ও ঘণ্টাখানেক চলেছে বলে খবর।
আরও পড়ুন: ভারতের চাপ! মাসুদ আজহারের দুই ভাই-সহ ৪৪ জঙ্গিকে গ্রেফতার করল পাকিস্তান
এই দুই বৈঠকের কোনওটি নিয়েই বিজেপি বা সঙ্ঘের কেউ মুখ খোলেননি। আর বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় ধোঁয়াশা তৈরি করেন দু’টি বৈঠক প্রসঙ্গেই। সোমবার রাতে সঙ্ঘ এবং বিজেপি নেতাদের সঙ্গে তাঁর কোনও বৈঠক হয়নি— এ কথা এক বারও বলেননি মিল্লি আল আমিন কলেজের অধ্যক্ষা। আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজনের সঙ্গেই আমার আলাপ-পরিচয় রয়েছে। সেই সূত্রে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয় বা কথা হয়।’’ কিন্তু বিজেপি-তে তাঁর যোগদান প্রায় পাকা এবং তিনি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হতে চলেছেন বলে যে জল্পনা শোনা যাচ্ছে, তার কি কোনও সত্যতা রয়েছে? এই প্রশ্নেরও স্পষ্ট উত্তর কলেজ শিক্ষিকা দেননি। বলেন, ‘‘কোনও সিদ্ধান্ত নিলে আগামীতে সবাই জানতে পারবেন।’’
বিজেপি সূত্রের খবর, বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ বারের লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করার বিষয়ে আলোচনা অনেকটাই এগোয় সোমবার রাতের বৈঠকে। শুধু সেটুকুই অবশ্য নয়, বৈশাখী ঠিক কী ভাবে বিজেপির কাজে লাগতে পারেন, তিনি দলে যোগ দিলে কী ধরনের দায়িত্ব তাঁকে পালন করতে হতে পারে— সে সব বিষয়েও কথা হয়। আলোচনা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতেই মঙ্গলবার কলকাতায় চলে আসেন অরবিন্দ মেনন। তার পরে কৈলাস এবং অরবিন্দ একসঙ্গে বৈশাখীর মুখোমুখি হন।
বিজেপির একটি অংশ দাবি করছে, কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। শোভন এবং বৈশাখী বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন বলে তাঁদের দাবি। তবে এ বিষয়ে বিজেপির রাজ্য বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কোনও রকম মন্তব্য এখনও করেননি। কয়েক দিনের মধ্যেই দিল্লিতে গিয়ে দলের সদর দফতর থেকে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় গেরুয়া পতাকা হাতে তুলে নেবেন বলে জল্পনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বৈশাখী নিজে সে সব জল্পনা নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছেন। আনন্দবাজারকে তিনি বলেছেন, ‘‘সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে এই সব জল্পনা ছড়ানো হচ্ছে। আমি কলকাতাতেই আছি, দিল্লি যাইনি।’’
জল্পনা নস্যাৎ করার চেষ্টা করলেও, বৈশাখী কিন্তু বিজেপি ও সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁর উপর্যুপরি বৈঠকের খবর নস্যাৎ করেননি। বৈঠকে তিনি বসেছেন কি না, তা স্পষ্ট করে জানাননি। কিন্তু বৈঠকে বসেননি, এমন কথাও এক বারের জন্যও বলেননি। দু’পক্ষের কথা যে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে, রাজ্য বিজেপি সূত্রেও সে কথা জানা যাচ্ছে। কথ যদি হয়ে গিয়েই থাকে, তা হলে আটকাচ্ছে কোথায়? দিল্লি থেকে অমিত শাহের দূত কলকাতায় এসে বৈঠক করে যাওয়ার পরেও বিষয়টি ঝুলে রয়েছে কেন? কোনও পক্ষই এ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি নয়। কিন্তু বিজেপি সূত্রের খবর, আলোচনা যাঁর সঙ্গে হচ্ছে শুধুমাত্র তাঁর যোগদানের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে না। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বিজেপি-তে যোগদানের সম্ভাবনা নিয়েও কথাবার্তা চলছে।
রাজনীতির অলিন্দে আগেই ছিলেন। এ বার কি সরাসরি ভোটের ময়দানে?—নিজস্ব চিত্র।
বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সমীকরণ নিয়ে শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ধমক শুনতে হয়েছিল খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। পরে মমতার সঙ্গে শোভনের দূরত্ব আরও বাড়ে, মন্ত্রিত্ব এবং মেয়র পদ ছেড়ে দেন শোভন। কিন্তু তিনি এখনও তৃণমূলের বিধায়ক এবং তৃণমূলের টিকিটে নির্বাচিত কাউন্সিলর। গত চার মাস দলের নেতৃত্বের সঙ্গে বিস্তর দূরত্ব বজায় রাখলেও শোভন কখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেননি। বরং আনুগত্য বহাল রাখারই ইঙ্গিত দিয়েছেন নানা ভাবে। তাই শোভনকে দলে টানতে পারলে তৃণমূলকে যে বেশ অস্বস্তিতে ফেলা যাবে, সে কথা বিজেপি ভালই বুঝতে পারছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।
শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বিজেপি যে সদ্য ভাবতে শুরু করেছে, এমনও নয়— দাবি রাজ্য বিজেপির একটি অংশের। মেয়র ও মন্ত্রিপদে শোভন ইস্তফা দেওয়ার পরে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে সর্বভারতীয় নেতৃত্বের ধমক খেয়েছিলেন বলে মুরলীধর সেন লেন সূত্রের খবর। পরে দিলীপ নিজের মন্তব্য সংশোধন করে নেন। বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম লালও কলকাতায় এসে শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করেন। এ বার নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, শোভন-বৈশাখীকে নিয়ে ততই বাড়ছে বিজেপির তৎপরতা।
বৈশখীকে বিজেপি প্রার্থী করার প্রস্তাব দেওয়ায় তাঁর প্রতিক্রিয়া কী, সে বিষয়ে শোভন চট্টোপাধ্যায় এখনও প্রকাশ্যে কোথাও মুখ খোলেননি। শোভনের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিজেপির প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব তাঁর কাছেও রয়েছে। কিন্তু এই নির্বাচনে তিনি কোনও দলের হয়েই ভোটে লড়তে খুব একটা আগ্রহী নন বলে খবর।
আরও পড়ুন: পুলিশের হাত থেকে দুষ্কৃতী ছিনতাই, জনতার সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ পার্কসার্কাসে
বিজেপি-তে যোগদানের প্রস্তাব সম্পর্কে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের অবস্থান সম্ভবত অতটা নেতিবাচক নয়। সে প্রস্তাবের বিষয়ে তাঁর তরফ থেকেও সুনির্দিষ্ট কিছু বক্তব্য রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সে সব বক্তব্য বিজেপি তথা সঙ্ঘ নেতৃত্বের কাছে পৌঁছেও গিয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার বৈঠকে শোভনের সেই সব বক্তব্য প্রসঙ্গে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈশাখীর আলোচনা হয় বলে জানা গিয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে শোভন এখনও একটু দ্বিধান্বিত বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে। তবে শোভনের বিজেপিতে যোগদানের জল্পনা ছড়িয়ে পড়তেই কলকাতা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন অংশ থেকে তাঁর অনুগামীরা তাঁকে এ দিন ফোন করে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন বলেও খবর।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার বৈঠকে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে গেরুয়া শিবিরের বার্তা— শোভন এবং বৈশাখীকে সঙ্গে পেতে অত্যন্ত আগ্রহী বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু সিদ্ধান্ত খুব বেশি দিন ঝুলিয়ে রাখা সম্ভব নয় বলেও বিজেপির তরফে জানানো হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শোভন এবং বৈশাখী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে খবর। তবে বিজেপিতে যোগদান করলে দু’জনেই করবেন, না হলে কেউ নন। খবর এমনই।
(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া -পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)