বীরভূমে পার্টি অফিসে অনুব্রত মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র
তিনি নির্বাচন কমিশনের নজরবন্দি। কিন্তু তার পরও নিজের জেলায় ভোটের দিন স্বমহিমাতেই দেখা গেল বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে। বাইকে গিয়ে নিজের ভোট দিলেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘একটা ফোন গিয়েছে তো কী হয়েছে, হাজারটা ফোন আছে।’’ একই সঙ্গে নজরবন্দির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলাও ঠুকেছিলেন অনুব্রত। আদালত অবশ্য সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।
‘চড়াম চড়াম ঢাক বাজানো’ থেকে ‘উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা’র মতো বিতর্কিত মন্তব্যের পর এ বারের লোকসভা ভোটে অনুব্রতর দাওয়াই ছিল ‘নকুলদানা’। তাঁর এই সব উক্তি যে আসলে রূপকধর্মী, তা আগেও বহুবার বোঝা গিয়েছে। ‘উন্নয়ন’ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে বলতে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, বোঝা গিয়েছিল পঞ্চায়েত ভোটের সময়। আর এ বারের লোকসভা ভোটেও ‘নকুলদানা’র আসল তাৎপর্য বোঝা গেল ভোট শুরু হওয়ার পর।
সেটা কী রকম? অনেক জায়গাতেই দেখা গিয়েছে, বুথের ২০০-২৫০ মিটার দূরে তৃণমূল কর্মীদের জটলা। অভিযোগ, ভোট দিতে যাঁরা বুথের দিকে যাচ্ছেন, তাঁদের আটকে দিচ্ছে ওই জটলা। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে মুড়ি-নকুলদানার প্যাকেট। কোথাও নকুলদানা বদলে গিয়েছে ঘুগনিতে।তার পর সেই প্যাকেট হাতে দিয়ে ফিরতি পথ ধরানোর অভিযোগ উঠেছে ভোটারদের। পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়ির দিকে। বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের নানুর এবং মঙ্গলকোটের একাধিক বুথে উঠে এসেছে এই ছবি।
‘নজরবন্দি’র খবর পাওয়ার পর অনুব্রত মণ্ডলের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘বয়েই গেল। ওতে আমার কিছু যায় আসে না। ভোটের দিন আমি কিছু করি না। কোথাও জ্বর, কোথাও মাথাব্যথার ওষুধ, যেখানে যেমন প্রয়োজন দিয়ে এসেছি।’’তবে কি ইঙ্গিত ছিল, যা করার আগেই সব ‘কাজ’ সেরে রেখেছেন? সোমবার ভোটের দিন কার্যত সেই ইঙ্গিতই ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়ে বেরিয়ে এল বীরভূমের নানুরে। সেখানে গ্রামের মহিলাদের নেতৃত্বে লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন বিজেপি সমর্থকরা। বেছে বেছে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বাড়িতে চড়াও হন।
কেন? ওই বিজেপি কর্মীদের অভিযোগ, ভোটের আগে থেকেই তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরা শাসিয়ে গিয়েছে। মারধরের অভিযোগও রয়েছে। এমনকি, তৃণমূলকে ভোট না দিলে ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয় বলেও এক বিজেপি কর্মী নালিশ করেন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মত, জেলার যে সব এলাকায় বিরোধী বাক্সে ভোট পড়ার সম্ভাবনা, সেখানেই এই ভয়-সন্ত্রাসের পরিবেশ আগে থেকেই সৃষ্টি করে রেখেছেন অনুব্রত। পর্যবেক্ষকদের এই অংশের বক্তব্য, ভোটের দিন নজরবন্দি করে সেই পরিস্থিতি পাল্টানো সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: ইভিএম-এর বোতামে আতর! ভোট দিয়ে বেরোলেই আঙুল শুঁকছেন তৃণমূল কর্মীরা
আরও পড়ুন: ‘দেরি করে বেড-টি দিল যে!’ দেরিতে ঘুম ভাঙায় গোলমালের খবর পাননি মুনমুন
কমিশনের নজরদারিতেই ভোটও দিতে গিয়েছেন অনুব্রত। সেখানেও তাঁকে যথেষ্টই আত্মবিশ্বাসী লেগেছে। সংবাদ মাধ্যমে বললেন, ‘‘খুব ভাল ভোট হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী খুব ভাল কাজ করছে।’’ ‘নকুলদানা’ নাকি ‘নজরবন্দি’, কোনটা জিতবে— এই প্রশ্নে বিন্দুমাত্র না ভেবেই বলে দেন প্রথমটা। তবে তার মধ্যেই বুথে ভোটকর্মীদের বলেন, ‘হাত চালিয়ে কাজ করুন’। অনুব্রতর এই মন্তব্যেরও তাৎপর্য খুঁজতে শুরু করেছে রাজনৈতিক মহল।
তবে কমিশনের নজরবন্দির সিদ্ধান্তকে আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছেন অনুব্রত। সোমবারই কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আর্জি জানিয়েছেন অনুব্রত। এ দিন আদালতে আইনজীবীরা কর্মবিরতি করছিলেন। তার মধ্যেই মামলা দায়ের করতে যাওয়ায় আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়কে ঘেরাও করেন আইনজীবীরা। তবে আদালত ওই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।