দমদম স্টেশনে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। ছবি: উজ্জ্বল চক্রবর্তী।
থিকথিকে ভিড় দমদম স্টেশনে। অনেকেই ট্রেনে চড়তে পারছেন না। কার্যত মারামারি করে ট্রেনে চাপতে হচ্ছে যাত্রীদের। সুবল পাত্র নামে এক যাত্রীর কথায়, ‘‘ট্রেনে উঠতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে। রীতিমতো মারপিট করতে হচ্ছে। এ ভাবে আর পারা যাচ্ছে না।’’
ডাউন ভাগীরথী এক্সপ্রেস দমদমের ইয়ার্ডে আটকে ছিল বহু ক্ষণ। ১০টা ২৫ মিনিটে শিয়ালদহ ঢোকার কথা ছিল ট্রেনটির।
দমদমের ইয়ার্ডে মূলত মালগাড়ি দাঁড়ায়। সেখানে ঘণ্টা তিনেকের বেশি দাঁড়িয়েছিল রাজধানী। নীচে এবড়োখেবড়ো জমি। পাথর। এই গরমে সেখানে অনেকে নেমে পড়েন। ওখান থেকে দমদম প্ল্যাটফর্ম অনেকটা দূরে। রেলের এক প্রাক্তন কর্তা বলেন, “শিয়ালদহে যে কাজ হচ্ছে তা পূর্বপরিকল্পিত। এই কাজের জন্য যে যাত্রীভোগান্তি হবে, তা জানা কথা। রাজধানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনকে কেন এমন করা হল বুঝতে পারলাম না। প্রয়োজনে তো আজকের জন্য ট্রেনটাকে হাওড়া ঢোকানো যেত!”
শিয়ালদহে রেলবিভ্রাটের কবলে পড়লেন ‘প্রিমিয়াম ক্লাস’ ট্রেন রাজধানী এক্সপ্রেসের যাত্রীরাও। শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ শিয়ালদহে পৌঁছনোর কথা ছিল যে ট্রেনের, সেই ট্রেন দুপুর দেড়টার সময় ঢুকল শিয়ালদহ স্টেশনে। তার আগে ঠায় তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইল দমদম স্টেশনের বাইরের অংশে। অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্য হারিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন যাত্রীরা। রাজধানী এক্সপ্রেসের যাত্রীদের এই দুর্ভোগ দেখে হতবাক অনেকেই।
শনিবার বেলা গড়াতেও শিয়ালদহের মেন এবং উত্তর শাখায় যাত্রীদুর্ভোগ কমেনি। বরং বেড়েছে বলেই মনে করছেন নিত্যযাত্রীরা। যে ট্রেনগুলি চলছে সেগুলি প্রতি স্টেশনেই ১০-১৫ মিনিট থেমে থেমে চলছে। শিয়ালদহ ঢোকার আগে দাঁড়িয়ে একাধিক ট্রেন। অনেকেই ট্রেন থেকে নেমে লাইন ধরে শিয়ালদহের দিকে হাঁটা লাগাচ্ছেন।
শুক্রবারের থেকে শনিবারের অবস্থা আরও ভয়াবহ বলে দাবি নিত্যযাত্রীদের। যে সব ট্রেন চালানোর কথা ছিল, তার বেশির ভাগই বাতিল করা হয়েছে বলে যাত্রীদের অভিযোগ। কোনও প্ল্যাটফর্মে কোনও রকমের ঘোষণা নেই। প্রতিটি ট্রেন প্রত্যেক স্টেশনে তো বটেই, দু’টি স্টেশনের মাঝেও দাঁড়িয়ে থাকছে দীর্ঘ ক্ষণ ধরে। নিত্যযাত্রী উৎসব পালের কথায়, ‘‘পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এক দিকে যেমন ট্রেন থেমে থেমে যাচ্ছে, আবার খবর পাচ্ছি শিয়ালদহের আগে অনেক ট্রেন দাঁড়িয়ে। ফেরার সময়ও মনে হয় কপালে দুর্ভোগ রয়েছে।’’
দমদম স্টেশনে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। ছবি: উজ্জ্বল চক্রবর্তী।
দমদম স্টেশন ঢোকার আগে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বনগাঁ লোকাল। দমদম থেকে শিয়ালদহ যাওয়ার রানাঘাট মেমুও দাঁড়িয়ে বিধাননগর ঢোকার আগে। সেই ট্রেন থেকে নেমে লাইন ধরে হাঁটছেন যাত্রীরা।
ট্রেন থেকে নেমে লাইন ধরে হাঁটছেন যাত্রীরা। ছবি: প্রীতম হালদার।
আপ কৃষ্ণনগর সিটি গ্যালপিং লোকাল প্রতিটি স্টেশনে থেমে থেমে যাচ্ছে। ভিড় অন্য দিনের তুলনায় বেশি।
ছবি: কমলিকা ভট্টাচার্য।
যে ট্রেনগুলি চলছে, সেগুলির সব ক’টি শিয়ালদহ স্টেশনে ঢুকছে না। অনেক ট্রেন দমদম পর্যন্ত আসছে। দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনেও থেমে যাচ্ছে বহু ট্রেন। এক একটি স্টেশনে ট্রেন আসছে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর পর। সেই ট্রেনগুলিতে তিলধারণের জায়গা নেই। ফলে অনেকেই উঠতে না পেরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝুলে ঝুলেই যাচ্ছেন।
ভিড়ের চাপে ট্রেনে উঠতে না পারার কারণে বিকল্প ব্যবস্থা করে গন্তব্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন নিত্যযাত্রীরা। বাসগুলিতে প্রচণ্ড ভিড়। ব্যারাকপুর এবং সোদপুরে অটো পেতে লম্বা লাইন মানুষের।
সোদপুরে অটোই ভরসা অনেক নিত্যযাত্রীর কাছে। ছবি: শৌভিক দেবনাথ।
ব্যারাকপুরের বাসিন্দা সুফল বিশ্বাস বলেন, ‘‘শুক্রবারের থেকে শনিবারের পরিস্থিতি আরও খারাপ, আরও ভয়ঙ্কর। কী ভাবে কাজে যাব বুঝতে পারছি না। ট্রেনে এত ভিড় যে, চাপতে ভয় লাগছে। ট্রেনের তরফে কোনও ঘোষণা করা হচ্ছে না ঠিক ভাবে। তাই আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছি।’’
শুক্রবার রেল কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছিল, শিয়ালদহ স্টেশনে কাজ চলায় কিছু রেল বাতিল করা হয়েছে এবং কিছু ট্রেনের যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। তবে পরিস্থিতি ততটাও খারাপ নয়। তবে নিত্যযাত্রীদের দাবি, শুক্রবারের থেকে শনিবারের পরিস্থিতি আরও খারাপ। আরও ভিড় বেড়েছে স্টেশনগুলিতে। ট্রেনে চাপতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে।
ভিড়ের চাপে শুক্রবার এই ট্রেন থেকেই পড়ে যান এক তরুণ। শনিবারও সেই ট্রেনে উপচে পড়া ভিড়। ছবি: শৌভিক দেবনাথ।
শুক্রবারের পর শনিবারেও যাত্রীদের ভোগান্তি অব্যাহত শিয়ালদহ উত্তর এবং মেন শাখায়। শনিবারও ট্রেন আসছে দেরিতে। অনেক ট্রেন থেমে থেমে আসছে। স্টেশনগুলিতে ভিড়ের চাপ এতটাই যে, অনেকে ট্রেনের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারছেন না।
শিয়ালদহের ১ থেকে ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সম্প্রসারণের কাজ চলছে। তার জেরে বদল আনা হয়েছে রেল পরিষেবায়। বহু ট্রেন বাতিল। অনেক ট্রেন যাত্রা শুরু ও শেষ করছে দমদম জংশন, দমদম ক্যান্টনমেন্ট, বারাসত এবং কল্যাণী স্টেশনে। এর জেরে যাত্রীদুর্ভোগের অন্ত নেই। শুক্রবার সকাল থেকেই শিয়ালদহ মেন এবং উত্তর শাখায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় সকাল থেকে রাত অবধি স্টেশনগুলিতে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গিয়েছিল। শুক্রবার সকালে টিটাগড় এবং খড়দহ স্টেশনের মাঝে ভিড়ের চাপে এক তরুণ ট্রেন থেকে পড়েও যান। পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর।