ফাইল চিত্র।
ডানলপ নিয়ে রাজ্য রাজনীতির পারদের ওঠানামা মোটেই অপরিচিত নয়। এ বার কার্যত ‘হিমঘরে’ চলে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী ডানলপ কারখানার নিলাম আসন্ন। সূত্রের খবর, আগামী সপ্তাহেই অনলাইনে নিলামে উঠবে হুগলির সাহাগঞ্জ এবং তামিলনাড়ুর অম্বাত্তুরে ডানলপ কারখানার শাখা। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই বক্তব্য, এর ফলে দেশের প্রথম টায়ার কারখানা ডানলপের অন্তিমযাত্রা কার্যত নিশ্চিত হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে কারখানাটির ‘ভ্যালুয়েশন’-এর কাজ শেষ হয়েছে। সূত্রের দাবি, এতে ডানলপের সাহাগঞ্জ শাখার থেকে যাওয়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য সাড়ে তিনশো কোটি টাকার কিছু বেশি। চারশো কোটি টাকার কিছু বেশি মূল্যের সম্পত্তি রয়েছে অম্বাত্তুর শাখায়। দু’টি কারখানার ‘প্লান্ট-মেশিনারি’ (অর্থাৎ কারখানার যন্ত্র, আচ্ছাদন বা শেড ইত্যাদি) এই দফায় নিলামে উঠবে। সাহাগঞ্জ শাখায় এই সম্পত্তির মূল্য প্রায় ১৩ কোটি এবং অম্বাত্তুরের তা প্রায় ২ কোটি টাকা। শিল্প পর্যবেক্ষকদের অনেকেই জানাচ্ছেন, ওই অর্থমূল্য থেকেই নিলাম প্রক্রিয়া শুরু হবে।
প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, কোম্পানি, ঋণদাতা, শ্রমিক-স্বার্থের কথা মাথায় রেখে ২০১২ সালেই ডানলপকে লিকুইডেশনের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। কিন্তু নানা আইনি প্রক্রিয়ার পরে শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালে লিকুইডেটরের নোটিস ঝোলে কারখানার গেটে। অর্থাৎ, লিকুইডেটর কারখানার সম্পত্তি বিক্রি করে পাওনাদারদের টাকা মেটাবে।
কোম্পানি বিশেষজ্ঞদের অনেকেই জানান, সাধারণত এই ধরনের নিলাম থেকে পাওয়া অর্থ সংশ্লিষ্ট সংস্থার ‘সিকিওরড ক্রেডিটর’ বা ব্যাঙ্ক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বকেয়া মেটানোর কাজে ব্যবহার করার হয়। এ ক্ষেত্রেও হয় তো তেমনই ঘটবে। তবে সূত্রের দাবি, গত বছরের গোড়ায় কলকাতা হাই কোর্ট নিযুক্ত লিকুইডেটরের তরফে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছিল ডানলপের যন্ত্রপাতি বিক্রি করা হবে। তখন বহু শ্রমিক ছিলেন, যাঁদের পাওনাগণ্ডা বাকি ছিল। ফলে প্রক্রিয়া ‘বাধাহীন’ ছিল না। কিন্তু এ বার আগে থেকেই শুরু হয়েছে বকেয়া পাওনাগন্ডা মেটানোর প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে সাহাগঞ্জ কারখানার ৫৪ জন স্থায়ী শ্রমিকের বকেয়া বাবদ প্রায় ২ কোটি এবং অন্য আরও ১১৩ জন শ্রমিকের (ইন্ডিভিজুয়াল ওয়ার্কমেন) বকেয়া বাবদ প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে এর বাইরেও কারও পাওনা থেকে যাচ্ছে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি।
বাম সরকারের সময় থেকেই ডানলপ নিয়ে জটিলতা অব্যাহত। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন সেই কারখানা নিয়ে আন্দোলনও করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের ১০ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়াও চালু করেছিল তাঁর সরকার। এখনও কারখানার শতাধিক কর্মীকে মাসে ১০ হাজার টাকা করে ভাতা দেয় রাজ্য। ২০১৬ সালে ডানলপকে অধিগ্রহণ করার জন্য বিধানসভায় বিল পাশ করে তৃণমূল সরকার। কিন্তু মমতার অভিযোগ ছিল, বিধানসভায় বিল পাশ করানোর পাশাপাশি কারখানাকে অধিগ্রহণ করতে চেয়ে কেন্দ্রকে চিঠিও দিয়েছিল রাজ্য। কিন্তু কেন্দ্র তা করতে দেয়নি। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে সাহাগঞ্জে গিয়ে মমতা বলেছিলেন, “(কেন্দ্রের উদ্দেশে) নিজেরাও করবেন না, আমাদেরও করতে দেননি।” প্রসঙ্গত, বিভিন্ন সরকারি সংস্থা বিক্রি করে দেওয়ার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তেরও কড়া বিরোধী এ রাজ্য।
তবে তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফিরে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এই দফায় তাঁর সরকারের লক্ষ্য হবে শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান। আগামী এপ্রিল মাসে রাজ্যে বসবে শিল্প সম্মেলনের আসর। দেশীয় শিল্পই যে সেই সম্মেলনে অগ্রাধিকার পাবে, তাও কার্যত স্পষ্ট করে দিয়েছে রাজ্য। এই পরিস্থিতিতে ডানলপের ‘অন্তিমযাত্রা’ আদৌ কাম্য ছিল কিনা, সেই প্রশ্ন অনেকের
মনে উঠেছে।
তবে প্রবীণ আইএএস অফিসারদের অনেকেই জানাচ্ছেন, ডানলপকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্য সরকারের সরাসরি কিছু করার ছিল না। তবুও রাজ্য কারখানাটিকে অধিগ্রহণ করার চেষ্ঠা করেছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব কেন্দ্রের কাছে পাঠাতে হয়। আবেদন খতিয়ে দেখে তাতে রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলে তবে রাজ্য সরকারি ভাবে অধিগ্রহণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সে সবই করা হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্র এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন না মেলায় তা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০১৫ সালে সংসদীয় প্রতিনিধি দল ডানলপের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছিল। কারখানাটিকে অধিগ্রহণ করলে যে লাভজনক করে তোলা যাবে, তারাও তখন সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না।