বাঁ দিক থেকে চার অনিচ্ছুক চাষি সুশান্ত ঘোষ, গোপাল ঘোষ, হেমন্ত ঘোষ এবং রঞ্জন ঘোষ। — নিজস্ব চিত্র।
জমি আন্দোলনের ঢেউ যে মাটি থেকে তীব্র হয়েছিল, সেখান থেকেই শিল্পের দাবিতে ফের পদযাত্রা শুরু করে চাকা ঘোরানোর চেষ্টায় নামছে বামেরা। তার প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে উঠছে, আফশোস করছেন সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকেরা!
শরীর শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকলে দীর্ঘ দিন বাদে কাল, শনিবার ফের সিঙ্গুরের মাটিতে পা রাখছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিঙ্গুর থেকে শালবনি বাম পদযাত্রার সূচনা হবে তাঁর হাতেই। রাজনীতির আলোচনায় সিঙ্গুর যখন ফিরে আসছে, অনিচ্ছুক জমি মালিকেরা তখন স্পষ্টই বলছেন, জমির টাকা না নিয়ে তাঁরা ‘ভুল’ই করেছিলেন! তবে তৎকালীন সরকার বা শাসক দলও আলোচনা না করে জমি নিতে গিয়ে সমস্যা বাধিয়েছিল, সেই সমালোচনা থেকেও সরছেন না তাঁরা। জমি নিয়ে জেদাজেদির জটিল রাজনৈতিক আবর্তেই সিঙ্গুরের হাজার একর চৌহদ্দি এখনও নিস্ফলা, সরাসরি তা-ও মানছেন সিঙ্গুরের অনিচ্ছুকেরা।
নিজের জমিতে বৃহস্পতিবার দুপুরে আলুর পরিচর্যা করছিলেন গোপালনগর ঘোষপাড়ার বাসিন্দা গোপাল ঘোষ। সিঙ্গুরের আগুনে দিনগুলিতে আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন। বেড়া ভেঙে ‘নিজের জমি’তে যাওয়ার চেষ্টা করে গ্রেফতারও হয়েছিলেন পুলিশের হাতে। সে কথাই ফের মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। অন্তত ১২ বিঘে জমি রয়েছে তাঁর প্রকল্প এলাকায়। ওই চৌহদ্দির বাইরে থাকা চার বিঘা জমিই গোপালবাবুর বল-ভরসা। কথায় কথায় বলে ওঠেন, ‘‘এখন মনে হয়, চেক না নিয়ে বোকামি করেছিলাম! চার বিঘে জমি, সরকারের দেওয়া মাসে ১৬ কিলো চাল আর দু’হাজার টাকায় কি আর সংসার চলে!’’ তিনি সাফ বলে দেন, ‘‘উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে জমি ছেড়ে দিতে আর এক বিন্দু ভাবব না!’’ তাঁর দাবি, শিল্প সিঙ্গুর ছেড়ে যাক, এমনটা কোনও দিনই চাননি, আজও চান না। বরং, হারানো শিল্প ফেরত এলে যে এখনও এই এলাকার চেহারা আমূল বদলে যাবে, সে ব্যাপারেও একমত এই প্রৌঢ়।
কমবেশি একই বক্তব্য সিঙ্গুরের সুশান্ত ঘোষ, হেমন্ত ঘোষ, রঞ্জন ঘোষদেরও। ওঁরা সবাই ‘অনিচ্ছুক’ চাষি। জমি রক্ষার আন্দোলনে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পাড়ার মন্দিরের চাতালে চাদর জড়িয়ে বসে এ দিন রঞ্জনের আক্ষেপ, ‘‘মমতাকে সেই সময় ওই ভাবে বিশ্বাস করে হয়তো ভুলই করেছি। আমাদের তো এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা!’’ রঞ্জন জানান, তাঁদের বিঘে পাঁচেক জমি প্রকল্প এলাকায় চলে গিয়েছে। এখন দু’-আড়াই বিঘে জমি চাষ করে কোনও মতে চলছে। সুশান্তবাবুর গরু রয়েছে। অন্যের বাড়িতে গরুর দুধ দুইয়ে সংসার চালান। তাঁর বক্তব্য, ‘‘হাত বাড়িয়েই রয়েছি। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে এখনই জমি দিয়ে দেব! আমার মতো অনেকেই এখন এই কথাই ভাবছেন।’’ আইনের দীর্ঘসূত্রিতা এড়াতে আদালতের বাইরে মীমাংসার পক্ষেও সওয়াল করছেন সেই সময় আন্দোলনে থাকা বহু চাষি। তৃণমূল নেত্রীর দীর্ঘ দিন সিঙ্গুরে না আসার ক্ষোভও আড়াল করছেন না তাঁরা।
আবার একই সঙ্গে হেমন্তবাবুরা বলছেন, ‘‘বুদ্ধবাবুরা তখন যা দাপট দেখিয়েছিলেন! আঙুল উঁচিয়ে আমাদের জমি নিয়ে নিয়েছিলেন! এ সব না করে সরাসরি আমাদের সঙ্গে কথা বললে হয়তো আজকের দিনটা আসত না!’’ বস্তুত, এই তাড়াহুড়োই সে দিন ধরাতে চেয়েছিলেন জ্যোতি বসু। জমির মালিকদের গোড়ার দিকের বিক্ষোভের আঁচ দলীয় সংগঠন কেন পেল না, সেই প্রশ্ন তুলে জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, ‘‘আমাদের কৃষকসভা কি ঘুমোচ্ছিল?’’ এখন দলে সে দিনের তা়ড়াহুড়োর ভুল মানছেন বুদ্ধবাবুও। সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘সিঙ্গুরে বেশি তাড়াতাড়ি করে ফেলেছিলাম। ফ্রন্ট আবার ক্ষমতায় এলে সিঙ্গুর তো বটেই, সর্বত্রই সতর্ক হয়ে এগোবে। সিঙ্গুরে শিল্পও হবে।’’
‘অনিচ্ছুক’ চাষিরা যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে জমি দেওয়ার কথা বলছেন, দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের অন্য পাড়ে সানাপাড়ায় তখন সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বিফল বাঙাল। স্বেচ্ছায় তখন জমি দিয়েছিলেন। কিন্তু শিল্প না হওয়ায় মন ভাল নেই তাঁরও। এখন পরিস্থিতিই যেন সিঙ্গুরের ইচ্ছুক-অনিচ্ছুকদের এক সরলরেখায় মিলিয়ে দিয়েছে! বামেদের পদযাত্রায় এখন উৎসাহী বিফল। তিনি বলছেন, ‘‘আমার ছেলে আর ভাইপো এক বছরের ট্রেনিং করেছিল। কিন্তু কারখানা না হওয়ায় চাকরি হল না। এখনও আন্দোলনকারীদের বোধোদয় না হলে আগামী প্রজন্ম ওদের ক্ষমা করবে না!’’