দিন গড়াতেই আবেগের রং লাল

শেষ পর্যন্ত বাতাসে ওড়া লাল আবির আর স্লোগানের উচ্ছ্বাসে শেষ হল গত কয়েকদিনের লাগাতার টানাপড়েন। একেবারে শেষ পর্যায়ে রবিবার রাতভরও কাউন্সিলরদের আগলে রেখে সোমবার সকালে পার্টি অফিস থেকে পুরভবন পর্যন্ত ‘বাসযাত্রা’ করে শুরু হয় বাম কাউন্সিলরদের দিন। সেই সময় পূর্ত ভবনে দলীয় কাউন্সিলরদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসে শেষ মুহুর্তের পরিস্থিতি বুঝে নেওয়া চেষ্টায় ছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দুই শিবিরের দূরত্ব তখন বড়জোর ৫০০ মিটার। আর দুই শিবিরেই তখন সক্রিয় দুই সেনাপতি অশোক ভট্টাচার্য এবং নান্টু পাল।

Advertisement

কৌশিক চৌধুরী

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৫ ০৪:১৯
Share:

মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর অশোক ভট্টাচার্যকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন স্ত্রী রত্নাদেবী। সোমবার বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

শেষ পর্যন্ত বাতাসে ওড়া লাল আবির আর স্লোগানের উচ্ছ্বাসে শেষ হল গত কয়েকদিনের লাগাতার টানাপড়েন।
একেবারে শেষ পর্যায়ে রবিবার রাতভরও কাউন্সিলরদের আগলে রেখে সোমবার সকালে পার্টি অফিস থেকে পুরভবন পর্যন্ত ‘বাসযাত্রা’ করে শুরু হয় বাম কাউন্সিলরদের দিন। সেই সময় পূর্ত ভবনে দলীয় কাউন্সিলরদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসে শেষ মুহুর্তের পরিস্থিতি বুঝে নেওয়া চেষ্টায় ছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দুই শিবিরের দূরত্ব তখন বড়জোর ৫০০ মিটার। আর দুই শিবিরেই তখন সক্রিয় দুই সেনাপতি অশোক ভট্টাচার্য এবং নান্টু পাল।
ততক্ষণে অবশ্য কাছারি রোডের রাস্তার ছবিটা একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছে। প্রধান ডাকঘর থেকে পুরভবন, রাস্তার দুই ধারের বাতিস্তম্ভ থেকে টেলিফোনের খুঁটি, লাল পতাকা ঝোলানো শুরু হয়েছে সর্বত্র। পুরসভার দেওয়ালও মুড়ে ফেলা হয় বামপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে। পুরভবন তো বটে বাঘাযতীন পার্ক থেকে আদালত মোড়, কলেজ পাড়া সর্বত্র জমায়েত করতে দেখা যায় বাম নেতা-কর্মীদের। হাতে গোনা কয়েকজন কংগ্রেস কর্মী এবং বিজেপি নেতার দেখাও মেলে। শাসক দলের লোক বলতে বেলা সাড়ে ১২ টা দেখা যায়, কয়েকজন পুরকর্মীকে। তাঁরাই এগিয়ে এসে লাল পতাকার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি দলের পতাকা ঝুলিয়ে চলে যান। কাউন্সিলরেরা ছাড়া জেলাস্তরের কোনও নেতার দেখাই মেলেনি।

Advertisement

নির্ধারিত সময় বেলা ১২টার আধঘণ্টা আগেই অশোকবাবু সব কাউন্সিলরকে নিয়ে পুরভবনে সভাকক্ষে ঢুকে পড়েন। কিছুক্ষণ পরেই চলে আসেন বামেদের সমর্থনে থাকা নির্দল কাউন্সিলর অরবিন্দ ঘোষও। আর তার পরে গাড়িতে করে দু’জন কাউন্সিলরকে কার্যত বগলদাবা করে পুরসভায় পৌঁছন বিজেপির স্থানীয় সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। ১টার কিছুক্ষণ আগেই সুজয় ঘটকের নেতৃত্বে চলে আসেন চার কংগ্রেস কাউন্সিলর।

বাইরের সংবর্ধনা মঞ্চের চত্বরে তখন বসার জায়গা তো দূরের কথা ভাল করে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। শিলিগুড়ির এসিপি (পূর্ব) পিনাকী মজুমদার, আইসি অচ্যিন্ত গুপ্ত গোটা চত্বরে ভিড় সামলাতে হিমসিম খেতে থাকেন। মেয়রের চেম্বার থেকে ভবনের সিঁড়ি, মূল গেট সর্বত্র পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। উৎকন্ঠার পারদ যত চড়েছে তত বেড়েছে উৎসাহীদের ভিড়। শহরের কিছু বিশিষ্টজন, আইনজীবী, লেখকদেরও কোনওক্রমে এগিয়ে চেযার খুঁজতে দেখা যায়। পরের পর আসতে থাকে লাল পতাকা নিয়ে মিছিল।

Advertisement

সভাকক্ষের ভিতর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র চালু থাকলেও উত্তাপ কমাতে তখন হিমসিম অবস্থা। দুই শিবিরের যোদ্ধাদের ঘনঘন জল খাওয়া, শীতাতপ যন্ত্র বাড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ চলতে থাকে পাল্লা দিয়ে। একদিকে অশোকবাবু যখন শপথবাক্যের চিঠিতে সই, নিজের পেন গুছিয়ে রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন, তখন নান্টুবাবু খেয়াল রাখা শুরু করেন তাঁদের দলের সকলে আসলেন কি না। প্রথমে শপথবাক্য পাঠের পর ফুল দিয়ে কাউন্সিলরদের পুর কতৃর্পক্ষের অভিনন্দন জানানো হয়। তা হতেই বিজেপির একদল নেতা দরজা খুলে ঢুকে তাঁদের দুই কাউন্সিলরকে বার হয়ে চলে আসতে বলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে কংগ্রেসের চার কাউন্সিলরও একই রাস্তায় হাঁটেন। বিজেপির সাংসদ বলেন, ‘‘আমরা সিপিএম, তৃণমূল দুই তরফেই সমদূরত্ব বজায় রাখলাম। যাঁদের সংখ্যা রয়েছে তাঁরা পুর বোর্ড গড়বে।’’

কংগ্রেসের পরিষদীয় নেতা সুজয়বাবু বলেন, ‘‘আমাদের সময় ওই দুটো দল কী করেছে তা সবাই দেখেছে। এখন নিজেরা চেয়ার নিয়ে মারামারি করছে। আমরা মানুষের রায় নিয়েছি। এসবের মধ্যে আর থাকছি না।’’ কংগ্রেস, বিজেপির ‘ওয়াকআউট’ দেখে ক্রমশ বাড়তে থাকে লাল শিবিরের উন্মাদনা।

এরই মধ্যে ভোটাভুটির আগে সভার সভাপতি কৃষ্ণ পাল বিরতি’র ঘোষণা করেন। অশোকবাবু তখন চেয়ারে কিছুটা গা এলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘জীবনে ছ’বার ভোটে লড়েছি। হারজিত দেখেছি। কিন্তু এমন টেনশন কোনওদিন হয়নি। প্রায় দুই মাস ধরে খাটুনি চলছিল। যাক আজকে মিটবে।’’ আর তৃণমূলের নান্টুবাবুকে দেখা যায়, পুরভবনের করিডরে মোবাইল হাতেই ঘোরাফেরা করে ফের সভাকক্ষে একাই ঢুকে যেতে।

মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর অশোক ভট্টাচার্যের জন্য আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনা সভায় বাম কর্মী-সমর্থকদের উচ্ছ্বাস।—নিজস্ব চিত্র।

দুপুর তিনটেয় মেয়রের নির্বাচন শুরু হয়। সভাকক্ষের বাইরে দুই দলের কাউন্সিলরেরা একসঙ্গেই চেয়ারের বসেন। সবাই মিলে মোবাইলের ছবি তোলা, ঠান্ডা পানীয় খাওয়া, হালকা মজাও চলতে থাকে। সেই সঙ্গে দরজায় উঁকি মেরে গণনার ফল জানার চেষ্টাও করেন কা‌উন্সিলরেরা। ঘন্টা খানেকের মধ্যে অশোকবাবু ২৪-১৬ ভোটে জিতেছেন ঘোষণা হতেই আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়েন বাম কাউন্সিলর কমল অগ্রবাল, শঙ্কর ঘোষ, মুকুল সেনগুপ্তরা। বাইরে তখন লাল পতাকা আর লাল আবির উড়িয়ে শুরু হয় উৎসব। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ২৪-১৭ ভোটে জেতেন বামেদের চেয়ারম্যান দিলীপ সিংহও।

এর পরে আর বাঁধ মানেনি আনন্দের। পুরভবনের মধ্যেও আবির মেখে ঢুকে পড়েন বাম কর্মীরা। খবর পেয়ে তৃণমূলের জেলার নেতারা লাগোয়া পূর্ত বাংলোয় বসে থাকলেও পুরসভার দিকে আর পা মাড়াননি। দলের কাউন্সিলরেরা অশোকবাবুদের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফিরে যান পূর্ত দফতরের বাংলোয়। দলীয় সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে সংবর্ধনা সভার পর বামেরা কেউ কর্মীদের নিয়ে আবির মেখে পাড়ায়, কেউবা অশোকবাবুর সঙ্গে পার্টি অফিসে পৌঁছান। ফেরার সময় অবশ্য বাম কাউন্সিলরদের জন্য কোনও বাসের ব্যবস্থা ছিল না।

সরকারি গাড়ি নিলেন না অশোক

নিজস্ব সংবাদদাতা • শিলিগুড়ি

মেয়র নির্বাচিত হলেও পুরসভার সরকারি লালবাতি লাগানো গাড়ি আপাতত ব্যবহার করবেন না বলে জানিয়ে দিলেন অশোক ভট্টাচার্য। সোমবার পুরসভায় ভোটাভুটি, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর নিজের পুরানো গাড়িতেই পার্টি অফিসে ফিরলেন শিলিগুড়ির মেয়র অশোকবাবু। তার আগে পুর আধিকারিকেরা অবশ্য নতুন মেয়রকে গাড়ি তৈরি রয়েছে বলে জানান। তাঁকে ওই গাড়ি ব্যবহার করার জন্য অনুরোধও করেন। কিন্তু অশোকবাবু তাঁদের জানান, আপাতত তিনি নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতেই চড়বেন। অশোকবাবুর কথায়, ‘‘সরকারি গাড়ি সরকারি অনেক কাজে লাগতে পারে। আমি নিজের গাড়িতে অনেকদিন ধরেই চড়ছি। এটাই ঠিক আছে। আপাতত মেয়রের সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছি না।’’ গত কয়েকদিন ধরেই মেয়রের জন্য বরাদ্দ গাড়িটি সাজিয়ে তোলা হয়। পরিস্কার করা, পর্দা লাগানোর কাজ চলে পুরোদমে। এ দিন সকাল থেকেই গাড়িটিকে ধুয়ে মুছে পুরসভার সামনে এনে রাখা হয়। পুলিশ পাহারার গাড়িটিতে চালককে সবসময় তৈরিও থাকতে বলা হয়। কিন্তু বিকালে অশোকবাবুর ঘোষণার পর ফের গাড়িটি পুরসভার নির্দিষ্ট গ্যারেজে ঢুকিয়ে রাখা হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement