তাঁর রেল প্রকল্পে বাধা নবান্নই

ঘোষণা করেছিলেন তিনি। বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁরই সরকার! রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের কোণে কোণে রেললাইন পৌঁছে যাক।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৫০
Share:

মাদার টেরিজার ‘শান্তিদান’-এ শিশুদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।

ঘোষণা করেছিলেন তিনি। বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁরই সরকার!

Advertisement

রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের কোণে কোণে রেললাইন পৌঁছে যাক। কিন্তু এখন তাঁর সরকারের জমি-নীতিই এ রাজ্যে নতুন রেলপথ তৈরি বা সম্প্রসারণে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মমতারই ঘোষণা করা একগুচ্ছ রেল-প্রকল্প বাস্তবায়নে যে জমি দরকার, তা অধিগ্রহণ করে দেওয়া সম্ভব নয় বলে রেল-কর্তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছে নবান্ন। অধিগ্রহণের প্রশ্ন খারিজ করে শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী নিজেও এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘রেল জমি কিনে নিক। আমরা সহযোগিতা করব।’’

পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছুঁয়ে গিয়েছে ভারতীয় রেলের তিনটি জোন— পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত। তিন জোনের কর্তাদের নবান্নে ডেকে রাজ্য প্রশাসনের মাথারা বলে দিয়েছেন, রেলপথ সম্প্রসারণ বা নতুন লাইন পাতার জন্য জমি চেয়ে দরবার করবেন না। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে নতুন জমি অধিগ্রহণ আইন বলবৎ হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাই রাজ্য জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে না।

Advertisement

রাজ্যের ভূমি দফতরের কর্তারা পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষকে আগেই এ কথা জানিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের অফিসারদের নবান্নে ডেকে ভূমি-সচিব মনোজ পন্থ তাঁদেরও একই বার্তা দিয়েছেন। অন্য দিকে নবান্ন থেকে বৈঠকের ডাক পেয়ে যাঁরা নতুন আশায় বুক বেঁধেছিলেন, সেই রেলকর্তারা হতাশা লুকোচ্ছেন না। ‘‘জমির আর্জি জানিয়ে রাজ্যকে বহু চিঠি দিয়েছি। জবাব মেলেনি। এ বার নবান্ন ডাকায় ভেবেছিলাম, প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষিত প্রকল্পগুলো দিনের আলো দেখবে। হল ঠিক উল্টোটা।’’— খেদ এক রেল-অফিসারের।


উদ্যোগ থমকে

জোন

প্রকল্প

পূর্ব

• তারকেশ্বর-চাঁপাডাঙা সিউড়ি-প্রান্তিক

•অন্ডাল বাইপাস সেতু

দক্ষিণ-পূর্ব

• দেশপ্রাণ-নন্দীগ্রাম • আমতা-বাগনান

• বোয়াইচণ্ডী-আরামবাগ • দিঘা-জলেশ্বর

উত্তর-পূর্ব

• বালুরঘাট-হিলিগাজোল-ইটাহার

• সীমান্ত কালিয়াগঞ্জ-বুনিয়াদপুর

• রায়গঞ্জ-ডালখোলা • সেবক-রংপো

তা সরকার ওঁদের ডেকে ঠিক কী বলল? ‘‘ওঁরা আমাদের পরিষ্কার বললেন, বারবার চিঠি পাঠিয়ে লজ্জা দেবেন না। কারণ, সরকার জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে না,’’ দাবি উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের এক অফিসারের। তাঁর কথায়, ‘‘সান্ত্বনা একটাই যে, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলও একই বার্তা পেয়েছে।’’

ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিভিন্ন সময়ে কম রেল-প্রকল্প ঘোষিত হয়নি। জমি না-পেয়ে রেল বোর্ড অধিকাংশে বরাদ্দ বন্ধ করেছে। আবার অধিগ্রহণের নোটিস সত্ত্বেও সময় মেনে অধিগ্রহণ না-হওয়ায় বেশ কিছু প্রকল্প বাতিল হয়ে গিয়েছে।

রেল-সূত্রের খবর: উত্তর-পূর্ব সীমান্তের এমনই চারটি প্রকল্প ২০১৩-য় খরচের খাতায় চলে গিয়েছিল। গুরুত্ব বিবেচনা করে সেগুলো ফের জিইয়ে তোলা হয়। জমির আর্জি জানিয়ে রাজ্যকে চিঠি দেয় উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ব রেলও তিনটি প্রকল্পের জন্য জমি চেয়েছিল, যার দাম বাবদ রাজ্যের কাছে ৮৫ কোটি টাকা জমা রাখা হয়। আর নতুন লাইন পাতার তাগিদে দক্ষিণ-পূর্ব রেল জমি চেয়েছে চারটি প্রকল্পের জন্য, যার অন্যতম হল মমতার স্বপ্নের দেশপ্রাণ-নন্দীগ্রাম লাইন।

নবান্ন শেষমেশ সব উদ্যোগেই কার্যত দাঁড়ি টেনে দিয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এক কর্তার আক্ষেপ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন, নন্দীগ্রামে ট্রেন চলুক। তবু লাইন পাতা গেল না। ওখানে জমিদাতাদের চাকরির দাবিও ছিল, যা আবার রেল বোর্ড মানেনি।’’ ওঁর উপলব্ধি, ‘‘রেলমন্ত্রী মমতার অনেক প্রকল্প বাণিজ্যিক লাভের কথা ভেবে হয়নি। তা-ও কিছু নতুন রেলপথ হলে রাজ্যের মঙ্গলই হতো।’’

অথচ মমতা জমানার গোড়ায় তো পুরনো জমি-আইন (১৮৯৪) মেনেই রেলের জন্য কিছু জমি রাজ্য অধিগ্রহণ করেছে? এখন করছে না কেন?

প্রশাসনের অন্দরের ব্যাখ্যা: মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতায় এসেই জানিয়ে দেন, রাজ্য জবরদস্তি জমি অধিগ্রহণ করবে না। তবে সেই মুহূর্তে রেল-সহ কেন্দ্র-রাজ্যের নানা প্রকল্পে অধিগ্রহণ-প্রক্রিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কোথাও অধিগ্রহণের নোটিস পড়েছে, কোথাও মালিকদের শুনানি শুরু বা শেষ, কোথাও শুধু জমির দাম চুকানো বাকি। ‘‘মাঝ পথে ওগুলো বাতিল করা হয়নি। কিন্তু নতুন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণও হয়নি।’’— বলেন এক ভূমি-আধিকারিক।

ভূমি-সূত্রের খবর: রাজ্যে বর্তমানে কোনও জমি অধিগ্রহণ আইন বলবৎ নেই। কারণ, ২০১৩-র নতুন আইনটি রাজ্য গ্রহণ করেনি, ফলে তার ভিত্তিতে কোনও বিধি তৈরি হয়নি। অতএব অধিগ্রহণের প্রশ্ন উঠছে না। এবং রেলকে সেটাই স্পষ্ট জানানো হয়েছে। বস্তুত সকলকেই নিজে থেকে জমি কিনে প্রকল্প করার পরামর্শ দিচ্ছে রাজ্য। -এক ভূমিকর্তার দাবি, ‘‘রেলের নিজস্ব আইনেও জমি অধিগ্রহণ করা যায়। ওরা তা-ই করুক না!’’ রেল তা করবে?

রেল-সূত্রের বক্তব্য: জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের মতো রেলের নিজস্ব জমি অধিগ্রহণ আইন থাকলেও তার সীমাবদ্ধতা আছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়গ্রস্ত এলাকার স্বার্থে বা অন্য কিছু ‘বিশেষ’ ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা যায়। যে ভাবে ডানকুনি ফ্রেট করিডরকে বিশেষ প্রকল্প ঘোষণা করে জমি নেওয়া হচ্ছে। ‘‘কিন্তু একটা রাজ্যের সব প্রকল্পকে তো ‘বিশেষ’ তকমা দেওয়া সম্ভব নয়!’’— মন্তব্য এক রেলকর্তার। পাশাপাশি ওঁরা জানাচ্ছেন, রেলের আইন প্রয়োগ করতে হলেও রাজ্যের সাহায্য জরুরি। কারণ, জমি অধিগ্রহণের নিজস্ব পরিকাঠামো রেলের নেই।

এমতাবস্থায় রেলের অভিমত, জমির প্রশ্নে রাজ্য সরকার নড়েচড়ে না-বসলে ক্রমে সব প্রকল্পই ঠান্ডা ঘরে চলে যাবে। শুনে নবান্নের কী প্রতিক্রিয়া?

রাজ্য বল ঠেলছে রেলের কোর্টে। ‘‘আমরা আমাদের মনোভাব ওদের জানিয়ে দিয়েছি। এখন রেল বোর্ড ঠিক করুক, তারা কী করবে।’’— বলছেন ভূমি-কর্তারা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement