পশ্চিমবঙ্গের ‘জমি ব্যাঙ্ক’-এ হাজার হাজার একর জমি মজুত। শিল্প ও পরিকাঠামো তৈরির জন্য চাইলে যে কেউ জমি পাবেন বলে গত চার বছর যাবৎ দেশে-বিদেশে আশ্বাস দিয়ে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর মন্ত্রীরা। অথচ পড়শি দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় স্থলবন্দর তৈরির যে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা, তার জন্য প্রয়োজনীয় সামান্য ক’একর জমিই সরকার জুগিয়ে উঠতে পারছে না!
পরিণামে পরিকল্পনাটি অংশত মুখ থুবড়ে পড়েছে। এবং সব জেনেও মমতার প্রশাসন নির্বিকার! ‘‘আমাদের কিচ্ছুটি করার নেই।’’— বলছেন শিল্প দফতরের এক কর্তা।
ভারতের পূর্ব দিকের রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের সীমান্ত-লাগোয়া এলাকায় বেশ কয়েকটি ‘ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন’ বা স্থলবন্দর চায় দিল্লি। এর ছ’টি গড়ে ওঠার কথা পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু মমতার সরকার সামান্য পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করে দিতে না-পারায় তিনটি স্থলবন্দরের পরিকল্পনা হয় বাতিল হয়েছে, কিংবা বাতিল হওয়ার পথে। আবার একটি তৈরি হলেও লাগোয়া রাস্তা সম্প্রসারণ আটকে গিয়েছে সেই জমি-জটেই।
নবান্নের খবর: স্থলবন্দরের জন্য পশ্চিমবঙ্গের যে ছ’টি জায়গা বাছা হয়েছে, সেগুলি হল: নেপাল সীমান্তের ফুলবাড়ি (জেলা দার্জিলিং), বাংলাদেশ সীমান্তের চ্যাংড়াবান্ধা (কোচবিহার), হিলি (দক্ষিণ দিনাজপুর), মহদীপুর (মালদহ), ঘোজাডাঙা ও পেট্রাপোল (উত্তর ২৪ পরগনা)। ফুলবাড়ি চালু রয়েছে। চ্যাংড়াবান্ধায় প্রকল্পের কাজ চলছে। পেট্রাপোলের স্থলবন্দর তৈরি হয়ে গিয়েছে, যদিও জমি-সমস্যায় সেখানে রাস্তা চওড়া করা যাচ্ছে না। আর বাকি তিনটের একটি ইতিমধ্যে বাতিলের খাতায়, দু’টি বিশ বাঁও জলে। কী রকম?
সরকারি সূত্রের খবর: ঘোজাডাঙায় স্থলবন্দর করতে সাড়ে আট একর জমি প্রয়োজন। তা অধিগ্রহণের জন্য ২০১১-র জুলাইয়ে জেলা প্রশাসনকে অগ্রিম ৫৫ লক্ষ টাকা পাঠায় সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউস কর্পোরেশন। প্রবল উৎসাহে জমি চিহ্নিত করা হলেও অধিগ্রহণপর্ব কার্যত এক পা-ও এগোয়নি। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রক ঘোজাডাঙা প্রকল্পটাই বাতিল করে অগ্রিম ফেরত চায়। সপ্তাহখানেক আগে এক লক্ষ টাকা বাদ দিয়ে বাকিটা ফেরতও দিয়ে দিয়েছে রাজ্য। ওটুকু জমিও অধিগ্রহণ করা গেল না কেন?
জেলা প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার যুক্তি, ‘‘ভূমি দফতর সবুজ সঙ্কেত দেয়নি। তা ছাড়া ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিয়েও ধোঁয়াশা ছিল।’’
একই দশা মহদীপুরের। সেখানে ১৫.৪ একর অধিগ্রহণের কথা ছিল। ‘‘২০১০ সালের মধ্যে জমি চিহ্নিত হয়ে যায়। পরে কোনও মালিক জমি দিতে রাজি হলেন না। তাই এক ছটাকও পাওয়া যায়নি।’’— বলছেন মালদহ জেলা প্রশাসনের এক কর্তা। তিনি জানান, এক বার ভাবা হয়েছিল, জমি কিনে নেওয়া হবে। কিন্তু মালিকদের অধিকাংশ শাসক দলের প্রভাবের সুবাদে স্থলবন্দর পরিচালনার শরিক হতে চান। তাতে ওয়্যারহাউস কর্পোরেশন বেঁকে বসে।
সমস্যা সেই তিমিরেই রয়েছে। পাশাপাশি জমির অভাবে হিলির প্রকল্পও কেঁচে যাওয়ার জোগাড়। সেখানে জেলা প্রশাসন যে খাস জমি কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের দেখান, স্থলবন্দর তৈরির পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। বাড়তি জমি নিতে জেলা প্রশাসন রাজি হয়নি।
মহদীপুর ও হিলির প্রকল্প কেন্দ্র অবশ্য এখনও বাতিল করেনি। তবে দু’টির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশেষ আশার বাণী কোথাওই শোনা যাচ্ছে না। বরং পেট্রাপোলের নবনির্মিত স্থলবন্দরটি ঘিরে একটু আশার আলো দেখা গিয়েছিল। ঠিক রয়েছে, অগস্টে নরেন্দ্র মোদী এর উদ্বোধন করবেন। তার পরেও আন্তর্দেশীয় বাণিজ্য বাড়াতে সেটি কতটা সহায়ক হবে, তা নিয়ে ঘোরতর সংশয়। কারণ, যশোহর রোডের হাল। ‘‘বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল-বাণিজ্য বাড়াতে যশোহর রোড ও ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দু’টোরই সম্প্রসারণ আটকে জমির জটে।’’— আক্ষেপ করেন কেন্দ্রীয় স্থলবন্দর সংস্থার এক কর্তা। যাঁর দাবি, ত্রিপুরার আখাউড়া সীমান্তে চওড়া রাস্তার দৌলতেই বাণিজ্য প্রায় তিন গুণ বেড়ে গিয়েছে।
রাজ্য প্রশাসনের একাংশ বলছেন, মমতার সরকার জমি অধিগ্রহণ না-করায় রাজ্যে অন্তত ৩৫টি রেল-প্রকল্প থমকে। মেট্রোরও কিছু কাজ আটকে। এ বার পড়শি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক উন্নতির পথেও রাজ্যের জমি-সমস্যা যে ভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাতে দিল্লির পাশাপাশি নবান্নের অন্দরেও উদ্বেগের ছায়া। রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার পর্যবেক্ষণ, ‘‘এ বার প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশও আগ্রহী। জমি-জটে হয়তো ভাবনাটি ধাক্কা খাবে।’’
তাতে রাজ্যেরও যে লোকসান, সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।