ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বাইরে কুণালকে টেনেহিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে তোলার সময় রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
হা-রে-রে থেকে ধাঁই ধপাধপ কিছু বাদ যায়নি। কিন্তু সব জলে গিয়েছে। অগত্যা বাহুবল-ই ভরসা। কুণাল ঘোষের কণ্ঠরোধ করতে গিয়ে সোমবার কার্যত কুস্তিগিরের ভূমিকা নিয়ে তারই নমুনা দেখাল ‘বাহুবলী’ পুলিশ। তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদের গলা পেঁচিয়ে চেপে ধরে তাঁকে গাড়িতে তোলা হল। যা দেখে প্রশ্ন উঠল, এ রাজ্যের পুলিশ কি আদৌ মানবাধিকারের তোয়াক্কা করে?
সারদা-কেলেঙ্কারিতে ধৃত কুণাল ঘোষ যাতে আদালত চত্বরে সংবাদ মাধ্যমের সামনে বেফাঁস কিছু বলে না বসেন, সে জন্য প্রশাসন তথা পুলিশের তৎপরতার অন্ত নেই। তাই কখনও কুণাল মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বর্গিদের মতো ‘হা-রে-রে’ ডাক ছেড়েছে। তাঁর গলার আওয়াজ ঢাকা দিতে আইনরক্ষকেরা সমবেত স্বরে ‘রুদালি’র (উত্তর ভারতের মড়াকান্না বিশারদ পেশাদার কাঁদুনে) মতো তারস্বরে ‘হায় হায়’ করছে সারদা-কাণ্ডের সৌজন্যে এ হেন অভূতপূর্ব দৃশ্যও দেখে ফেলেছে কলকাতা। রুদালি-পুলিশকে সঙ্গত করতে আর এক দল আবার তালে তালে গাড়ি চাপড়ে ‘ধাঁই-ধপাধপ’ আওয়াজ তুলেছে! দেখে-শুনে এজলাসেই এক দিন কুণাল বলেছিলেন, “ছোটবেলায় শুনতাম, বর্গিরা হা-রে-রে-রে করে। এখন দেখছি, পুলিশও করে!” এক বার তো পুলিশ নিজের টুপি খুলে কুণালের মুখে চেপে ধরেছিল!
এত কিছু করেও কুণালের গলা অবশ্য চাপা দেওয়া যায়নি। বরং দলনেত্রী সম্পর্কে প্রকাশ্যে একের পর এক বিস্ফোরক মন্তব্য করে গিয়েছেন তিনি। সোমবারও যখন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বাইরে সেটা করতে গেলেন, তখন পুলিশ পিছন থেকে কু্স্তিগিরের কায়দায় হাতের প্যাঁচে ওঁর গলাই চেপে ধরল। সেই অবস্থায় টেনে-হিঁচড়ে তুলল গাড়িতে। এ দিন কণ্ঠরোধের আগে কুণাল শুধু বলতে পেরেছিলেন, “সারদা কেলেঙ্কারিতে যিনি সব থেকে বেশি সুবিধা নিয়েছেন, তাঁকে গ্রেফতার করা হোক। অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হোক।”
কুণালের পথে হেঁটে প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খানও শাসকদলের নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। প্রতারণার মামলায় ধৃত আসিফ পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে ‘ডাকাতরানি’ বিশেষণে ভূষিত করেছেন। পুলিশের এক কর্তা এ দিন বলেন, “ওঁদের দু’জনের মন্তব্যগুলো যাতে সংবাদ মাধ্যমের কাছে না পৌঁছয়, সে জন্য এত দিন বর্গি-রুদালি হয়ে শব্দবটিকা দাওয়াই প্রয়োগ করা হচ্ছিল। তাতে কাজ না-হওয়ায় বাহুবলেই ফিরতে হল।”
কথা কোয়ো না। গলা চেপে প্রিজন ভ্যানে তোলার পরেও এ ভাবেই গাড়ি চাপড়ে কুণালের আওয়াজ থামাতে চাইল পুলিশ। - নিজস্ব চিত্র
এবং এ দিন সেই দাওয়াইয়ের দৃষ্টান্ত দেখে আইনজীবীদের অনেকে পুলিশের সমালোচনায় সরব। এঁদের মতে, সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুখ খুলে কুণাল বেআইনি কিছু করছেন না। “অথচ পুলিশ যে ভাবে ওঁর উপরে বলপ্রয়োগ করছে, তা মানা যায় না। বোঝা যাচ্ছে, মানবাধিকার সংক্রান্ত সেমিনারে পুলিশ-কর্তারা যতই গালভরা কথাবার্তা বলুন না কেন, রাজনৈতিক চাপে পড়লে তাঁরা আইন-কানুনের ধার ধারেন না।” পর্যবেক্ষণ এক জনের। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “কুণালবাবুর উচিত তাঁর কৌঁসুলি মারফত আদালতের কাছে অভিযোগ জানানো। অভিযুক্তের কি কথা বলার অধিকার নেই?” কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের মন্তব্য, “পুলিশের এমন কাজ করা উচিত নয়।”
রাজ্য মানবাধিকার কমিশন কী বলে?
কমিশনের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। বিষয়টি জানতে চেয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে ফোন করা হয়েছিল। তিনি ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব আসেনি। পুলিশি আচরণের কোনও সরকারি ব্যাখ্যা পুলিশ-কর্তাদের কাছে স্বভাবতই নেই। তবে তাঁরা দৃশ্যত অস্বস্তিতে। একান্তে এক জনের স্বীকারোক্তি, “সবই তো বুঝছেন! ‘ওঁরা’ চান না, কুণাল বা আসিফ মুখ খুলুক।” পুলিশের এক সূত্রের খবর, কুণাল-আসিফের মুখ আটকাতে না-পারায় সংশ্লিষ্ট বিধাননগর ও কলকাতার পুলিশ-কর্তাদের কপালে সরকারের উপরমহলের কাছ থেকে তিরস্কার জুটছে। তাই এখন পিঠ বাঁচানোর চেষ্টায় কসুর হচ্ছে না। বিশেষত কুণালের বাক্যবাণ রুখতে ইদানীং ষণ্ডা চেহারার তাগড়াই কর্মীদের বাছাই করা হচ্ছে। কোর্টে আসার আগে তাঁদের ‘যথাকর্তব্য’ বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে।
সেই ‘কর্তব্য’ই পালন করেছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্মীরা। কী ভাবে?
সারদার সংবাদ মাধ্যম ‘চ্যানেল টেন’ সংক্রান্ত পার্ক স্ট্রিট থানার এক মামলায় এ দিন কুণালকে ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হয়। নগর দায়রা আদালতে যেমন পুলিশভ্যান সরাসরি কোর্ট লক-আপের দরজায় পৌঁছে যেতে পারে, ব্যাঙ্কশালে তেমন সুবিধা নেই। সেখানে কোর্ট লক-আপের দরজা পেরিয়ে ভ্যানে ওঠার আগে কিছুটা হেঁটে আসতে হয়। ওখানে এসেই থমকে যান কুণাল। বলতে শুরু করেন, “আমাকে হেনস্থার জন্যই মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ দিয়ে মিথ্যে মামলায় ফাঁসাচ্ছেন।” সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে। কুণালকে আড়াল করে ভ্যানের দিকে টেনে আনা হয়। ভ্যানে ওঠার মুখে কুণাল পা-দানিতে বসে পড়েন। বলতে থাকেন, “সারদা-কাণ্ডে যিনি সব থেকে বেশি সুবিধা পেয়েছেন, তাঁকে গ্রেফতার করা হোক। মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হোক।”
তখনই পুলিশ হাত দিয়ে পেঁচিয়ে কুণালের গলা চেপে ধরে। কুণালের কথা আটকে যায়। তাঁর হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা চলতে থাকে। হ্যাঁচকা টান রুখতে মরিয়া কুণাল গাড়ির হাতল আঁকড়ে ধরে ফের মুখ্যমন্ত্রীর নাম করে কিছু বলতে শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার পিছন থেকে কুস্তিগিরের মতো তাঁর গলা পেঁচিয়ে ধরেন এক পুলিশকর্মী। চলতে থাকে টানা-হ্যাঁচড়া। কুণালের দেহের অর্ধেকটা কোনও মতে গাড়ির ভিতরে ঢুকতেই দু’পা ধরে তুলে তাঁকে কার্যত গাড়ির মধ্যে ছুড়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
‘হাতের প্যাঁচ’ দেখানোর পাশাপাশি কুণালকে আড়াল করতে এ দিন রীতিমতো ট্র্যাপিজের কসরত দেখিয়েছেন কয়েক জন পুলিশকর্মী। চলন্ত ভ্যানে ‘বাঁদরঝোলা’ হয়ে সফর করেছেন। ফলিয়েছেন কমান্ডোগিরি। কুণালের কাছে পৌঁছতে চাওয়া সাংবাদিকদের নিরন্তর কনুই মেরে ধরাশায়ী করার চেষ্টা হয়েছে। কারও কারও বুকে-পেটে এন্তার ঘুষি মারা হয়েছে, কলার ধরে টানাটানিও বাদ যায়নি। প্রতিবাদ করা হলে জয়দেব দাস নামে এক এএসআই সদর্পে বলেন, “বেশ করেছি। কিছু করতে পারলে করে নিন!” যা শুনে আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রৌঢ়ের তির্যক মন্তব্য, “এমন বুকের পাটা থাকলে ফাইলে মাথা ঢেকে টেবিলের তলায় লুকোনোর দরকার কী?” ব্যাঙ্কশাল কোর্টে উপস্থিত কলকাতা পুলিশের এক অফিসারের আক্ষেপ, “উর্দি পরে যা করা হচ্ছে, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।”
সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনও এ দিন ব্যাঙ্কশালে হাজির ছিলেন। কুণালের পাঁচ মিনিট আগে তিনি কোর্ট লক-আপ থেকে বেরোন। তাঁকে নিয়ে অবশ্য সংবাদ মাধ্যম উৎসাহী ছিল না, ফলে পুলিশেরও মাথাব্যথা ছিল না। পার্ক স্ট্রিট থানার মামলাটিতে সম্প্রতি সুদীপ্ত ও কুণালের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা পড়েছে। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বিচারক শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে কুণাল প্রশ্ন তোলেন, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই সারদা-কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে, সেখানে কলকাতা পুলিশ এই মামলার আলাদা তদন্ত করছে কেন?” ওঁর অভিযোগ: রাজ্য সরকার আসলে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইছে।
কুণালের কৌঁসুলি অয়ন চক্রবর্তী জানান, বিচার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য বিচারক মামলাটিকে নগর দায়রা আদালতে পাঠিয়েছেন। পরবর্তী শুনানি ১২ ডিসেম্বর।