বয়স্কদের জীবনসাথী সম্মেলনে মেয়ের সঙ্গে হাজির মা। রবিবার চেতলায় ছবিটি তুলেছেন শুভাশিস ভট্টাচার্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন-পর্ব চুকিয়েই পড়িমরি হাজির সদ্য এমএসসি দেবকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ মায়ের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে সাক্ষী থাকতে হবে তো!
মা সোমা চট্টোপাধ্যায় স্কুলের ভূগোল দিদিমণি। জ্ঞান হওয়া ইস্তক মেয়েকে একাই বড় করে তুলেছেন বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা। মেয়ে বলছিলেন, “ক্লাস নাইনে আমার টাইফয়েডের সময় দেখেছিলাম, মা কী ভাবে একা হাতে সব সামলাচ্ছে! তখনই বুঝি মায়ের পাশে কাউকে দরকার।” এখন দেবকন্যার ভয়, এ বার কলকাতার বাইরে চাকরি-টাকরি হলে মাকে দেখবেটা কে! মেয়ের নির্দেশে টুকটুকে লং স্কার্টে উজ্জ্বল মাতৃদেবী তাই রবিবার সকাল-সকাল হাজির হয়েছেন।
স্থান: চেতলার মহেশ্বরী বিকাশ ভবন। উপলক্ষ: বয়স্কদের জীবনসাথী সম্মেলন। প্রবীণদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর তত্ত্ব-তালাশ করতে এমন আসর এ শহরে অভূতপূর্ব। ছক-ভাঙা বুড়োবুড়িদের সঙ্গে সেখানেই দেখা হয়ে গেল। যেমন ৭৪ বছরের ব্যায়াম শিক্ষক বসন্তকুমার ঠক্কর। বছরখানেক আগে স্ত্রী বিয়োগের পরে প্রবাসী সন্তানদের প্রশ্রয়েই ফের গাঁটছড়া বাঁধতে চান। এখনও অনায়াসে শীর্ষাসন পারেন। “গীতবিতান আমার বাইবেল’ বলে ‘বঁধূ মিছে রাগ ক’রো না’ গেয়ে চমকে দিলেন সাড়ে তিন দশক ধরে ‘ক্যালকাটান’ এই গুজরাতি।
গত কয়েক দশক ধরে মানুষের গড় আয়ু চড়চড়িয়ে বৃদ্ধির পটভূমিতে এই অন্য রকম জীবন-সন্ধ্যাকে বিশেষজ্ঞেরা স্বাগতই জানাচ্ছেন। বেশি দিন বাঁচাটাই সব নয়! কী ভাবে বাঁচছি, সেটাও জরুরি। তাই “বুড়ো বয়সের একাকীত্ব ঘোচাতে বেশি বয়সের সম্পর্ক একটি স্বীকৃত দাওয়াই!’— দাবি বার্ধক্যবিজ্ঞান বিশারদ ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর । প্রবীণদের বিষয়ে এ দেশের দৃষ্টিভঙ্গি যে পাল্টাচ্ছে, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন আমদাবাদবাসী জনৈক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। নাথুভাই পটেলের উদ্যোগে গোটা গুজরাত-সহ মুম্বই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, ইনদওর প্রমুখ শহরে ৮০টির বেশি জুটি ঘর বেঁধেছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, লিভ-ইন সম্পর্কও স্বীকৃত। কয়েক জন পরিজনদের জানিয়ে একসঙ্গে থাকছেন।
প্রবীণদের এই ঘটকালির আসরে হবু পাত্র-পাত্রীরা মাইক হাতে নিজের পরিচয় দিলেন। সাদা কাগজে টুকে নিলেন পছন্দের মানুষটির নাম। তার ভিত্তিতে এক কোণে বসে প্রথম আলাপের ব্যবস্থা করে দিলেন আয়োজকেরা।
কিন্তু সব আলাপের পরিণতিই কী সুখের হয়! দক্ষিণ কলকাতার চন্দ্রিমা (পুরো নাম বলতে অনিচ্ছুক) তাই চান, মা প্রথমে পছন্দের মানুষটির সঙ্গে থাকতে শুরু করুন। পরে বিয়ের কথা ভাবা যাবে। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই একা। এখন ষাট পেরিয়ে সমস্যা বেড়েছে। মায়ের জন্য সুপাত্রের ‘লিস্ট’ করে চন্দ্রিমা বললেন, “মাকে দেখার কেউ নেই। আমার বা বোনের বাড়িতে থাকেন। ওঁর একটা নিজের জায়গা খুব দরকার।” এই নিজস্ব পরিসরটুকুর খোঁজে এসেছেন অনেকেই। দক্ষিণ কলকাতার এক বৃদ্ধা ভিন্ রাজ্যে শ্বশুরবাড়ি যেতেও রাজি। চুঁচুড়ার এক মহিলা ছেলে-বৌমার সংসারে মানিয়ে নিতে পারছেন না। সামনেই চাকরি থেকে অবসর। মহিলা জানিয়ে দিলেন, নিজের বাড়িটা কিন্তু ছেলেকেই লিখে দেবেন। সকালে নাম লেখানোর সময়ে দেখা গেল তাঁর আশঙ্কা, কেউ হয়তো টাকা বা সম্পত্তির লোভে সম্পর্ক গড়তে চাইবেন।
সেল-এর অবসরপ্রাপ্ত কর্তা তুষারকান্তি বিশ্বাসের আবার অন্য সমস্যা। মেয়ে-জামাই-নাতি পুণেবাসী। স্ত্রী-বিয়োগের পরে ঝাড়া হাত-পা বছর দশেক। দেশ-বিদেশে বেড়িয়ে কলকাতায় থাকেন বছরে মাস তিন-চার। বললেন, “সঙ্গী খুঁজলেও নিজের মতোই বাঁচতে চাইব। কোথাও আমার মনের মানুষ পেলাম না।” স্বয়ংবরা হতে আমদাবাদ থেকে এ শহরে হাজির ভার্গবী বি নায়েক। লতার গান শুনিয়ে বললেন, আমার কোনও দায়দায়িত্ব নেই। কলকাতায় যৌথ পরিবারে থাকতেও রাজি। আর্মি স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক শ্যামবাজারের শ্যামসুন্দর হালদার (স্ত্রী গত হয়েছেন)-এর সঙ্গে একান্তে অনেক কথা হল ভার্গবীর। শ্যামসুন্দর বললেন, “শাকাহারী বউ জুটলে না হয় মাছ ছেড়েই দেব।”
মুম্বই-বেঙ্গালুরুর তুলনায় অবশ্য কম সাড়া দিয়েছে কলকাতা। রাজপুত্রের তুলনায় রাজকন্যাও কিছু কম। ৬০ জন পুরুষ ও ২৫ জন মহিলা ছিলেন। তবু প্রবীণ লেখক সমরেশ মজুমদার বলছিলেন, “একলা থাকাটাকে শেষ কথা বলে এঁরা মানছেন না দেখেই চমৎকার লাগছে! আমার বয়সী অনেকেই তো নিঃসঙ্গতার শিকার।”
চুঁচুড়ার প্রৌঢ়া বলছিলেন, “পাছে লোকে কিছু বলে-র দেওয়ালটা ভাঙতে সময় তো লাগেই!” পরিচয়-পর্বে মান্না দে-র শরণ নিলেন রাজপুরের সোমনাথ চন্দ্র। ‘সবাই তো সুখী হতে চায়, কেউ সুখী হয় কেউ হয় না!’ শুনে এক পক্ককেশ হবু কনের মন্তব্য, ‘‘মিস্টার বা মিসেস রাইটকে খুঁজে পাওয়াটা কোনও বয়সেই সোজা কথা নয়!’’