যুদ্ধটা পরিচিত। তবু তা ঘিরেই সরগরম হয়ে ওঠে উৎসবের ময়দান।
নয়ের দশকে থিম পুজোর শুরু থেকেই উঠে এসেছিলেন এক ঝাঁক নতুন শিল্পী। মহানগরকে উপহার দিয়েছিলেন নতুন নতুন ভাবনা। সময়ের সঙ্গে তাঁরা উঠে এসেছেন প্রথম সারিতে। কারও কারও চুলে পাকও ধরেছে। তবু নতুন থিমের জোগানে তাঁরা অক্লান্ত।
থিম পুজোর গোড়াতেই উঠে এসেছিলেন দুই শিল্পী অমর সরকার, ভবতোষ সুতার। প্রথমে জুটি বেঁধেই কাজ শুরু করেছিলেন। পরে আলাদা হয়েও নিজের নিজের জাত চিনিয়েছেন দু’জনে। এ বারও দু’জনে আলাদা ভাবেই শহরকে ‘পুজোর উপহার’ দেওয়ার তাল ঠুকছেন। অমর রয়েছেন চারটি পুজোয়। দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘে নর্মদার তীরে বিভিন্ন উপজাতির শিল্প তুলে আনছেন। মাটি, কাপড়, বাঁশের সঙ্গে উপকরণে থাকছে আয়নাও। গোলাঘাটা সম্মিলনীতে চোঙা, বক্স, ভেঁপু দিয়ে শব্দ দূষণের থিম গড়ছেন। হরিদেবপুর স্পোর্টিং ক্লাবে সাবেক পুতুল। হাওড়ার সুবল স্মৃতি সঙ্ঘে থাকছে শিবলিঙ্গ।
বেহালা থেকেই পুজো লড়াইয়ের যাত্রা শুরু করেছিলেন ভবতোষ সুতার। বেশ কয়েক বছর পরে এ বার ফের তিনি পুরনো পাড়ায়। বেহালা নূতন দলে তাঁর থিম সমুদ্রমন্থন। ব্রহ্মাণ্ডের রূপক হিসেবে থাকছে কলসি। বাটানগর নিউল্যান্ড ক্লাবে বিরাট খাঁচায় অচিন পাখির থিম গড়ছেন ভবতোষ।
পোস্তার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট থেকে গোবর আর ডোকরার শিল্প দেখিয়ে পুজো ময়দানে সুনাম কুড়িয়েছিলেন প্রশান্ত পাল। দিনে দিনে তিনি প্রথম সারির অন্যতম খেলোয়াড়। এ বারে তাঁর হাতে শহরের নামজাদা পাঁচটি ক্লাবের দায়িত্ব। দক্ষিণের নামী পুজো হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীনে প্রাচীন খেলনা, তালপাতার পাখা, ফুলঘট, পুতুল নাচের সামগ্রী দিয়ে মেলার ধাঁচে সাজিয়ে তুলছেন মণ্ডপ। থিমের ভাষায়, উৎসব যেথায় মিলনের। লালাবাগান নবাঙ্কুরে তুলে ধরছেন বাংলার পুরনো শিল্প-সংস্কৃতি। উল্টোডাঙা সংগ্রামীতে মণ্ডপ সাজছে কাগজ-সুতোয়। খিদিরপুর পল্লি শারদীয়াকে প্রশান্ত তুলে ধরছেন গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, কৃষ্ণা ও গোদাবরীর পৌরাণিক চরিত্রকে। বেঙ্গল ইউনাইটেড ক্লাবের পুজো প্রশান্ত দেখাবেন মায়াজাল। মণ্ডপকে ঘিরে থাকবে কাচ, রাংতার মায়াবী পরিবেশ।
শহরের পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে সনাতন দিন্দার নামও। উত্তরের হাতিবাগান থেকে যাত্রা শুরু করে সনাতন এখন ‘দক্ষিণপন্থী’। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের পুজো বলে পরিচিত চেতলা অগ্রণীতে ফেলে দেওয়া তেলের ড্রাম, চেয়ার, টিনের কৌটো দিয়ে কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে থিম সাজাচ্ছেন তিনি। যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লিতে শিল্পী গড়ছেন সাদা-কালো মণ্ডপ। আর রঙের আধিক্য থাকবে প্রতিমায়। দেবীঘট ও বিষ্ণুপুরের পাটা চিত্রের পাশে মিলতে পারে ‘বডি পেন্টিং’-এর আভাস।
ভিড় টানার লড়াইয়ে শহরের অন্যতম কারিগর সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতি বারের মতো এ বারও তিনি নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘে। সেখানে থিম হিসেবে তামিলনাড়ুকে তুলে আনা হচ্ছে। ‘আম্মার’ রাজ্যের থিম সং লিখেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টালা বারোয়ারি সুব্রতর থিম জিনপ্রযুক্তির বিরুদ্ধে। নজর কাড়তে সুকুমার রায়ের ‘হাঁসজারু’র ঢঙে ইতিমধ্যেই হাইব্রিডাসুরকে ফেসবুকে ছেড়েছে টালা বারোয়ারি। গত কয়েক বছরে ট্যাংরা ঘোলপাড়ায় নতুন নতুন থিম দিয়েছেন সুব্রত। এ বার সেখানে তিনি গড়ছেন সমুদ্রমন্থন।
বহু বছর আগে রাজস্থানের দিলওয়ারা মন্দির করে শহরকে তাক লাগিয়েছিলেন শিল্পী দীপক ঘোষ। পুজোর ময়দানে ‘মাটির মানুষ’ বলে পরিচিত দীপকবাবু এ বার যোধপুর পার্কে মাটি দিয়ে তুলে আনছেন আফ্রিকার বৃষ্টি-অরণ্য। সেখানকার উপজাতির দেবী ওসানকে দুর্গার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন তিনি। শহরে থার্মোকল নিয়ে কাজ করতে গেলেও উঠে আসে দীপকবাবুর নাম। লেক গার্ডেন্স পিপলস অ্যাসোসিয়েশনে থার্মোকলেই ইন্দো-আর্য এবং মুঘল-রাজপুত ঘরানার শিল্প ফুটিয়ে তুলছেন তিনি। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের পুজোয় প্লাইউড ও সিসামুক্ত রং দিয়ে মণ্ডপ সাজাচ্ছেন তিনি।
শহরে বহু বার থিমের লড়াইয়ে চমক দেখিয়েছেন শিল্পী সুশান্ত পাল। এ বার তিন-তিনটি পুজোর ভাগ্য তাঁর হাতে। সেলিমপুর পল্লিতে সুশান্ত তুলে আনছেন বাঙালির পুজোর নস্টালজিয়াকে। বেহালা ফ্রেন্ডসে থিম হিসেবে বেছে নিয়েছেন সমাজে নারীর অবস্থানকে। সুশান্ত বলছেন, নারী যেমন দেবী, আবার সে সমাজে নিগৃহীতাও হয়। এ কাজে সুশান্তের পাশাপাশি উঠে আসছেন নবীন শিল্পী লীনা জায়সবালও। উল্টোডাঙা পল্লিশ্রীতে সুশান্ত তুলে ধরছেন উৎসবের আনন্দকে।
লড়াই জমজমাট। প্রথম সারির খেলোয়াড়েরা কী চমক দেন, তার অপেক্ষাতেই রয়েছে উৎসুক মহানগর।