দেবযানী
বৃহস্পতিবারের তিনি এবং শুক্রবারের তিনির মধ্যে জমিন-আসমান ফারাক।
যে পার্থ দে বৃহস্পতিবার ভাতের থালা ছুড়ে ফেলে সারা দিন ‘টাচ মি, টাচ মি, জেসাস, জেসাস’ বলে চিৎকার করেছেন, সেই তিনিই শুক্রবার সকাল থেকে একেবারে লক্ষ্মীছেলে! উত্তেজনা নেই, অস্থিরতা নেই, চেঁচামেচি নেই। স্নান করেছেন, নখ কেটেছেন, ঠিক সময়ে খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন, ঘরের বাইরের করিডরে বসে অন্যদের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তাও বলেছেন, যিশুর বাণী শুনিয়েছেন।
পাভলভ হাসপাতালের দুই রোগী বিভাস ও অনুপ তো মুগ্ধ। পার্থবাবুর সামনেই তাঁরা বলে ওঠেন, ‘‘আপনি বাংলা আর ইংরেজিতে কী সুন্দর কথা বলেন! কত শিক্ষিত আপনি!’’ খানিকটা উদাস মুখেই পার্থর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি আর কী শিক্ষিত? আমার দিদিকে দেখলে বুঝতেন, শিক্ষিত কাকে বলে।’’
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন এক মহিলা কাউন্সেলার কথা বলতে গেলে পার্থ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আপনাকে কি আগে কখনও দেখেছি?’’ মহিলা জানান, আগে কখনও দেখা হয়নি তাঁদের। শুনে পার্থ বলেন, ‘‘খুব চেনা লাগছে।’’ এর পরে ওই কাউন্সেলারকে পার্থ বলেন, ‘‘আমার তো এই জায়গায় থাকার কথা নয়। এখানে কোনও ইতিবাচক অনুভূতি হচ্ছে না। এরা আমাকে মাদার হাউসে নিয়ে যাচ্ছে না। আপনি কি একটু ব্যবস্থা করতে পারেন, যাতে আমি মাদার হাউসের কয়েক জন সিস্টারের সঙ্গে কথা বলতে পারি!’’
রবিনসন স্ট্রিটের রহস্য ভেদে পার্থর দিকেই তাকিয়ে তদন্তকারীরা। কয়েক বছর ওই ‘হানাবাড়ি’র অন্দরে কী হয়েছে, তা জানতে একমাত্র ভরসা তিনিই। কিন্তু পার্থর যা মানসিক অবস্থা, তাতে তাঁকে জেরা করে লাভ হবে না বলেই ভাবছেন মনোবিদেরা। দে-বাড়ির রহস্য উন্মোচনে পুলিশকে পাভলভে গিয়ে পার্থকে জেরা করার অনুমতি দিয়েছে আদালত। এ দিন অবশ্য পুলিশের তরফে কেউই পার্থকে জেরা করতে যাননি।
সুস্থ হয়ে উঠতে কত সময় লাগতে পারে পার্থর? তাঁকে যে দিন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়, সে দিন মনোবিদ সব্যসাচী মিত্র সেখানে তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষণ কথা বলেছিলেন। সব্যসাচীবাবুর বক্তব্য, পার্থর মানসিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল নয়। নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে থাকলে এক মাস পর থেকে তিনি একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। পাভলভের চিকিৎসকদের ধারণা, পুরোপুরি সুস্থ হতে পার্থর দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। কিন্তু তার পরেও যে তদন্তের সুবিধা হবে, এমনটা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না তাঁরা। কারণ, সুস্থ হওয়ার পরে জীবনের বেশ কিছুটা পর্বের কথা পার্থ ভুলে যেতে পারেন, সেই আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মিলবে না।
পার্থর জন্য গড়া মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যদের প্রাথমিক ধারণা, পার্থবাবু ‘ফ্রোলিয়া ট্রায়োস’-এ আক্রান্ত। এটা স্কিৎজোফ্রেনিয়ার একটা অংশ। এই মানসিক অবস্থায় রোগী বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। নানা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বাঁচে এবং তার মধ্যে অত্যধিক যৌন তাড়নাও দেখা যেতে পারে। এরা অনেক সময় অদ্ভুত-অদ্ভুত গন্ধ পায় বা গন্ধই পায় না।’’ অনেক সময় একটা পরিবারের বহু সদস্য ‘ফ্রোলিয়া ট্রায়োস’ এ আক্রান্ত হতে পারেন। তখন গোড়াই তাঁদের আলাদা-আলাদা জায়গায় রেখে চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
পার্থর ক্ষেত্রে বোর্ড আপাতত ঠিক করেছে, তাঁকে প্রতিদিন ডায়েরি আর পেন দেওয়া হবে। আলাদা করে গান শোনানোর ব্যবস্থাও থাকবে। হয়তো কিছুটা চেনা পরিবেশে চাপা অনুভূতি বা কথা বেরোতে পারে। পাভলভে রোগীদের জন্য সপ্তাহে কয়েক দিন গানের ক্লাস হয়। সেখানেও পার্থকে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ দিন বারান্দায় বসে পার্থ কোনও এক গানের সুরও গুনগুনিয়েছেন বলেও পাভলভ সূত্রের খবর।
দে-বাড়ির প্রতিটি ঘরে ছোট ছোট মিউজিক বক্স লাগিয়ে গানের সুরে ইংরেজি মন্ত্র বাজানো হতো প্রায় সারা দিন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজির অধ্যাপিকা সুব্রতা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘সুরটা নয়, গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলি। যদি মন্ত্রে বলা হয়— ‘আমি যা-ই করি না কেন, ঈশ্বর আমার সব পাপ ধুয়ে দেবেন, তা হলে অনবরত তা শুনতে-শুনতে বাড়ির সদস্যদের মনে হতেই পারে, তাঁরা পাপ করলেও ক্ষমা পাবেন।’’
দে-বাড়িতে অপরাধ ঘটেছিল কি না জানতে ফরেন্সিক-সাইকোলজিস্টদের সাহায্য নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে পুলিশ। কলকাতার কিছু ফরেন্সিক-সাইকোলজিস্ট জানান, যে সব জিনিস, খাবার, চিরকুট, পুতুল, ডায়েরি, বই মিলেছে, বা যে ভাবে কঙ্কালগুলি রাখা ছিল, তার থেকে পরিবারের সদস্যদের অসুস্থ বা বিকৃত যৌনতার আভাস মেলে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন্সিক সাইকিয়াট্রিস্ট দীপেশচন্দ্র নাথের মতে, ছ’মাস একই ঘরে খাটের পাশে কঙ্কালের সঙ্গে থাকাটা শারীরিক আকর্ষণ ছাড়া সম্ভব নয়। কঙ্কালের মাথা যত্ন করে কাপড় দিয়ে ঢাকা দেওয়া, পায়ে মোজা পরিয়ে পাশে খেলনা, খাবার রেখে দেওয়াটাও সেই ইঙ্গিতবহ।