আপন জনকে স্মরণ। রবিবার, স্টিফেন কোর্টের সামনে। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
ছেলে সায়রকে বলেছিলেন আসতে। সে আসতে চায়নি।
এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে সায়র। ১৫ বছরের কিশোর হাত নেড়ে বলেছে, কী হবে গিয়ে!
সত্যিই তো! কোনও প্রতিশ্রুতি নেই, কোনও আশ্বাস নেই, কোনও আশা নেই। কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না।
তবুও আজকের দিনে সাধনা সেনগুপ্ত এক বার গিয়ে দাঁড়াতে চান সেই অভিশপ্ত বাড়িটার সামনে।
গত তিন বছর ধরে এ ভাবেই এই দিনটিতে এসেছেন। চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছেন কিছুক্ষণ। তার পর মাথা নিচু করে ফিরে গিয়েছেন।
এই রবিবারেও মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেননি সাধনা। বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে হাওড়ার রামরাজাতলা থেকে গুটি গুটি পায়ে চলে এসেছিলেন ফাঁকা পার্ক স্ট্রিটে। অভিশপ্ত বাড়ির সামনে কার্ড-বোর্ডে সাঁটা সত্যজিতের ছবি কয়েকটি ইটের উপরে রেখে, ছবির গলায় জ্যালজেলে একটা মালা পরিয়ে সামনে জ্বেলে দিয়েছেন একটি মোমবাতি আর কয়েকটি ধূপ। পাশে সৌরভ বারিকের ছবিটা একটু বড়, ল্যামিনেট করা। দু’টি ছবির জন্য ওই একটিই মালা।
২০১০-এর ২৩ মার্চ দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল জমজমাট পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্ট। ৪৩টি প্রাণ আপ্রাণ চেষ্টা করেও বাঁচতে পারেনি। সেই তালিকায় ছিল সত্যজিৎ সেনগুপ্তের নাম। ছিলেন সৌরভ বারিক, তপতী চক্রবর্তীরাও।
ষষ্ঠ শ্রেণির ছেলে সায়রকে নিয়ে সে দিন থেকেই শুরু হয়েছে সাধনাদেবীর বেঁচে থাকার লড়াই। রাজ্যের তরফে ২ লক্ষ টাকা পাওয়া গেলেও, অনেক প্রতিশ্রুতির পরেও চাকরি মেলেনি। যার জন্য বহু বার কড়া নেড়েছেন নেতা-নেত্রীদের দরজায়।
কথা বলার ফাঁকে আজও কান্না ঠেলে ওঠে গলার কাছে। কোনওক্রমে বলেন, “ঘটনার পর একটানা কয়েক দিন রামরাজাতলার বাড়িতে মিডিয়া, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ভিড় কম হয়নি। রেলে একটা চাকরি হয়ে যাবে, এই প্রতিশ্রুতিতে অনেক ঘুরেছি। কেউ কথা রাখেননি।” দুর্ঘটনার দিন কয়েক পরে সত্যজিতের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া গিয়েছিল ১৪ টাকা। আর সাধনাদেবীর নিজের সম্বল বলতে তখন হাতে ছিল ১৯০ টাকা।
এর পরেও যে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করিয়ে ছেলেকে সুশিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ, দাঁতে দাঁত চেপে সেই স্কুলে পড়িয়ে গিয়েছেন। এগিয়ে এসেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। বেতন মকুব হয়েছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছেন এমন অনেক অনাত্মীয় মানুষ। যে গাড়িতে চেপে সায়র স্কুলে যেত, সেই গাড়ি টাকা নেয়নি কয়েক বছর। যে কোচিং সেন্টারে সায়র ক্রিকেট শিখত, তারাও বেতন মকুব করে দেয়।
প্রতিশ্রুতির সেই চাকরির আশা ছেড়ে বেসরকারি সংস্থায় সামান্য বেতনের চাকরি নিয়েছেন সাধনাদেবী। তাঁর কথায়, “সায়র ক্লাস নাইনে ওঠার পরে নতুন বই কেনার টাকা ছিল না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল। সত্যজিতের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, কেন ছেড়ে চলে গেলে আমায়?” সে বারও এগিয়ে এসেছেন এক বান্ধবী।
এক বন্ধুকে নিয়ে সত্যজিৎ অফিস খুলে বসেছিলেন স্টিফেন কোর্টে। অন্যদের চাকরি দেওয়ার কনসালটেন্সি ফার্ম। আগুনের শিখা গিলে খেয়েছে দুই বন্ধুকেই। সাধনাদেবী চাকরি পাননি। উল্টে বলা হয়েছে, কোনও দিন যদি স্টিফেন কোর্ট আবার গড়ে ওঠে, তা হলে একটি অফিসঘর ভাড়ায় পাওয়ার কথা সত্যজিৎদের। তখন জানানো হবে তাঁকে।
সত্যজিতের নিজের অফিস ছিল। তাঁকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কেউ ছিল না। কিন্তু, সৌরভ বারিক চাকরি করতেন এমন এক সংস্থায়, যার দফতর ছিল স্টিফেন কোর্টে। আগুন গ্রাস করেনি সৌরভকে। বাঁচার তাগিদে উপর থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তিনি। হাসপাতালের মর্গে গিয়ে তাঁর দেহ শনাক্ত করেছিলেন তাঁর বাবা শৈলেনবাবু ও কবিতাদেবী ।
রবিবার দুপুরে স্টিফেন কোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসে ওঠেন শৈলেনবাবু। চার বছর আগের একটি ইংরেজি দৈনিকের কাটিং বার করে দেখান, সৌরভের সেই সংস্থার কর্তার বক্তব্য। শৈলেনবাবুর অভিযোগ, তখন বলা হয়েছিল, ওই সংস্থার যে কর্মীরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু, চার বছরে একটি টাকাও পাওয়া যায়নি। এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি আইনজীবীর চিঠি দিয়ে সংস্থার তরফে তাঁদের জানানো হয়েছে, ক্ষতিপূরণ দেওয়া যাবে না।
স্টিফেন কোর্ট অগ্নিকাণ্ড নিয়ে রাজ্যের করা মামলা চলছে আদালতে। আগামী ৪ এপ্রিল তার পরবর্তী শুনানি। রবিবার যেমন স্টিফেন কোর্টের সামনে জড়ো হয়েছেন, সে দিনও তেমনই আদালতে গিয়ে হাজির হবেন শৈলেনবাবুরা।
জানেন না, কবে শেষ হবে এই আদালত যাওয়া-আসা! কবে গিয়ে বিচার পাবেন তাঁরা!