পশুদের এলাকায় ঢুকে সশব্দে ছবি তুলে বা চেঁচামেচি করে তাদের শান্তিভঙ্গ করা হলে, তার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেবে না সরকার? ফাইল ছবি।
পরিখা বা খাঁচার গণ্ডি পেরিয়ে কখনও উড়ে আসে খাবার, কখনও ঢিল। চিৎকার-চেঁচামেচি থেকে রেহাই পেতে কখনও ঘরে ঢুকে, কখনও খাঁচার এক কোণে সরে গিয়ে ‘আত্মরক্ষা’র চেষ্টা করে তারা। প্রজননের সময়েও কোলাহল মানসিক ব্যাঘাত ঘটায়। আলিপুর হোক বা দার্জিলিং, চিড়িয়াখানার বন্যপ্রাণীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবিত নন বেশির ভাগ দর্শকই। সম্প্রতি জলদাপাড়ায় ধেয়ে আসা গন্ডারের সামনে গাড়ি উল্টে গিয়েদুর্ঘটনার পরে পর্যটকদের জন্য বিমা চালুর কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। কিন্তু প্রাণী বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, পশুদের এলাকায় ঢুকে সশব্দে ছবি তুলে বা চেঁচামেচি করে তাদের শান্তিভঙ্গ করা হলে, তার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেবে না সরকার?
শিশুদের কাছে বা শিক্ষামূলক ভ্রমণের জন্য চিড়িয়াখানার আকর্ষণ চিরকালের। কিন্তু বড়দিন, বর্ষবরণের সময়ে সেই আকর্ষণ লাগামছাড়া উচ্ছৃঙ্খলতার রূপ নেয়। দর্শকদের কোলাহল যে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করে, তা মানছেন বিশেষজ্ঞেরা। জঙ্গলের প্রাণী আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকে গিয়ে অথবা তেড়ে এসে অসন্তোষ দেখালেও চিড়িয়াখানার বাসিন্দাদের সেই সুযোগ নেই। ফলে মানসিক অশান্তিতে ভোগে তারা। আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রাক্তন চিকিৎসক নারায়ণদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, জঙ্গল ও চিড়িয়াখানায় থাকা পশু— উভয়ের কাছেই অতিরিক্ত কোলাহল সমান অসহ্য। তাঁর কথায়, ‘‘অতিরিক্ত ভিড়ের সময়ে গন্ডারেরা দূরে, এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পাখি রোদের থেকে ছানাদের আড়াল করতে পাখা মেলে দাঁড়ায়। কিন্তু অতিরিক্ত ভিড়ে সেই কাজে সমস্যা হওয়াই স্বাভাবিক।’’
প্রধান মুখ্য বনপাল সৌমিত্র দাশগুপ্ত জানান, এই সমস্যার সমাধানে বিকল্প পথের খোঁজে রয়েছে বন দফতরও। তিনি বলেন, ‘‘জলদাপাড়ার ঘটনার তদন্ত চলছে। রিপোর্ট তৈরির পরে কী কী প্রস্তাব আসে, দেখা যাক। এ ভাবে প্রাণীরা যাতে সমস্যায় না পড়ে, সে নিয়েও ভাবা হচ্ছে।’’
চিড়িয়াখানা সূত্রের খবর, এক প্রাক্তন আধিকারিক তাঁর কর্মজীবনে একটি শিম্পাঞ্জির সঙ্গে সখ্য তৈরি করতে যাওয়ায় শিম্পাঞ্জিটি তাঁর আঙুলে কামড়ে দেয়। তাই বন্যপ্রাণীদের আচরণ আগাম অনুমান করা অসম্ভব বলেই মতামত বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের মতে, চিড়িয়াখানার বাসিন্দাদের রেগে গিয়ে তেড়ে আসার সুযোগ থাকে না। কিন্তু জঙ্গল বা অভয়ারণ্যে অনেক সময়েই এমন ঘটার আশঙ্কা থাকে।
আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রাক্তন অধিকর্তা আশিস সামন্তের দাবি, খাঁচার সামনে ভিড় করে পশুপাখিদের উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা বর্তমানে কমেছে। তবে, অত্যধিক কোলাহল পশুপাখিদের কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘‘যে কারণে সাপের মতো অন্যান্য প্রাণীর, বিশেষত বাঘ, চিতাবাঘ, প্যান্থারদের কাচের দেওয়ালের আড়ালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যাতে কোলাহল তাদের মানসিক শান্তিতে ব্যাঘাত না ঘটায়। তবে খাঁচায় খাবার বা ইট ছুড়লে চড়া অঙ্কের জরিমানা করা হয়।’’ কিন্তু কোলাহল বন্ধে চিড়িয়াখানায় ‘সাইলেন্স জ়োন’ তৈরি বা জরিমানা কেন করা হবে না, সেই প্রশ্ন উঠছে।
সম্প্রতি জলদাপাড়ার ভিডিয়োটিতে দেখা গিয়েছে, ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে দু’টি গন্ডার বেরিয়ে আসার সময়ে গাড়িতে থাকা পর্যটকেরা চিৎকার জুড়েছেন। তাতেই রেগে গিয়ে গন্ডার দু’টি গাড়ির দিকে দৌড় শুরু করেছিল কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। জঙ্গলে ‘সাফারি’র নামে বন্যপ্রাণীদের বিরক্ত করার উপরে রাশ টানার পক্ষে সওয়াল করছেন কেউ কেউ। হুড খোলা গাড়িতে বিপজ্জনক ভাবে পর্যটকদের কেন জঙ্গলে ঘোরানো হবে, উঠছে সেই প্রসঙ্গও।
বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য বলছেন, ‘‘পর্যটকদের জরিমানা করা যাবে না। তবে বন্যপ্রাণীরা যাতে বিরক্ত না হয়, তেমন ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হবে। চিড়িয়াখানায় সাইলেন্স জ়োন করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’’