বাঁ দিকে, উদ্ধারকারী দম্পতি। ডান দিকে, উদ্ধার হওয়া তরুণী। —নিজস্ব চিত্র।
রাতের শহরে এক তরুণীর শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে বিপন্ন এক দম্পতি। ওই মহিলাকে উদ্ধার করতে পারলেও উদ্ধারকারী মহিলার পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয় দুষ্কৃতী। উদ্ধারকারী মহিলা বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শনিবার রাতে মায়ের জন্মদিন উপলক্ষে আনন্দপুরে মায়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়। কালিকাপুরের বাসিন্দা নীলাঞ্জনার সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী দীপ শতপথী এবং তাঁদের একমাত্র কন্যা। রবিবার দীপ আনন্দবাজার ডিজিটাল-কে জানিয়েছেন, ‘‘রাত প্রায় ১২টা নাগাদ আমরা আমার শাশুড়ির বাড়ি থেকে নিজের গাড়িতে বাড়ির দিকে রওনা দিই। আমাদের পিছনে আসছিল একটি হন্ডা সিটি গাড়ি। সেই গাড়ি থেকে একটি মেয়ে বার বার বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলেন।’’
মেয়েটির চিৎকার শুনে নীলাঞ্জনা তাঁর স্বামীকে গাড়িটি আটকাতে বলেন। দীপ বলেন,‘‘আমি নিজের গাড়ি দিয়ে পিছনের হন্ডা সিটিটাকে আটকাই। তার পরে আমার স্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে পড়েন।’’ নীলাঞ্জনা গাড়ি থেকে নেমে পিছনের গাড়ির দিকে এগতেই, ওই গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় এক তরুণীকে। দীপের বর্ণনা অনুযায়ী, ওই তরুণীর জামাকাপড় বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া ছিল, মুখ চোখ ফোলা, যেন মারধর করা হয়েছে। মুখে হাতে পায়ে নখের চিহ্ন ছিল।
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্ত ৯০ হাজারের বেশি, তবে স্বস্তি দিয়ে দেশে সুস্থতাও সর্বোচ্চ
ওই তরুণীকে রাস্তার ধার থেকে যখন তুলছেন, ঠিক সেইসময় ওই হন্ডা সিটি গাড়ির চালক প্রবল স্পিডে গাড়িটা ব্যাক গিয়ারে দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। দীপের অভিযোগ,‘‘ওই হন্ডা সিটির চালক প্রচণ্ড গতিতে আমার স্ত্রীর পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে যান। একটুর জন্য আমার স্ত্রী-র মাথা ওই গাড়ির চাকার তলায় পিষে যায়নি।’’ ঘটনাটি ঘটে রাত ১২টা নাগাদ। ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়েন নীলাঞ্জনা। হতবাক হয়ে দীপ এর পরে পুলিশের সাহায্য চান। কারণ, প্রথমে তিনি রুবি হাসপাতালে ফোন করলেও কোনও অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়া যাচ্ছিল না। ১০০ ডায়াল-এ ফোন করার পর কসবা ট্রাফিক গার্ডের এক সার্জেন্ট ঘটনাস্থলে পৌঁছন এবং তাঁর উদ্যোগে কলকাতা পুলিশের ট্রমা কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্স কর্মা পৌঁছায়। সেই কর্মা অ্যাম্বুল্যান্সে নীলাঞ্জনাকে বাইপাসের ধারে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
তত ক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় আনন্দপুর থানার পুলিশ। প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, উদ্ধার হওয়া তরুণীর নাম মধুশ্রী সরকার ( নাম পরিবর্তিত)। তিনি আদতে জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। কলকাতায় একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্মী। নয়াবাদ এলাকায় থাকেন। সপ্তাহ খানেক আগে পরিচয় হওয়া এক যুবকের যুবকের সঙ্গে ডেটিংয়ে বেরিয়েছিলেন তিনি। অভিযোগ, ওই যুবক ফাঁকা রাস্তায় ওই তরুণীকে নিয়ে গিয়ে শ্লীলতাহানি করেন। তরুণী ওই যুবককে বাধা দিলে তাঁকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। গাড়ির মধ্যে তাঁর জামা-কাপড় ছিঁড়েও দেওয়া হয়।
অন্যদিকে নীলাঞ্জনার স্বামী দীপ শতপথী জানিয়েছেন,‘‘নীলাঞ্জনার মাথায় আঘাত লেগেছে। ছ’টা সেলাই করতে হয়েছে। অন্যদিকে ডান পা হাঁটুর তলা থেকে পুরো ভেঙে গিয়েছে। সিনবোন টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। নীলাঞ্জনার কোভিড পরীক্ষা করা হচ্ছে। কোভিড রিপোর্ট পাওয়ার পর এই অস্ত্রোপচার করা হবে।’’
আরও পড়ুন: মাদককাণ্ডে এ বার সমন রিয়াকে, এনসিবির দফতরে অভিনেত্রী
তবে দীপের অভিযোগ, অভিযুক্তকে পাকড়াও করার ব্যাপারে ততটা উদ্যোগী হয়নি পুলিশ। তিনি বলেন, ‘‘আমরা বার বার আনন্দপুর থানার পুলিশকে অনুরোধ করেছিলাম নীলাঞ্জনার ঘটনার একটি আলাদা মামলা করতে। পুলিশ রাজি হয়নি।’’ পুলিশ সূত্রে খবর, উদ্ধার হওয়া তরুণীর বয়ানের ভিত্তিতে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে। বাকি ঘটনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাটি ঘটেছে আনন্দপুরের আর আর প্লটের অভ্যুদয় হাউজিং কমপ্লেক্সের সামনে। মধুশ্রী নামে ওই তরুণীর সঙ্গে কয়েকদিন আগে অমিতাভ বসু নামে এক যুবকের আলাপ হয়। শনিবার তাঁরা একসঙ্গে বেরিয়েছলেন। কিছুক্ষণ ঘোরার পর ওই তরুণী অমিতাভকে তাঁর বাড়িতে নামিয়ে দিতে বলেন। পুলিশকে উদ্ধার হওয়া তরুণী জানিয়েছেন, বার বার বলার পর অমিতাভ তাঁকে গাড়ি থেকে নামাতে রাজি হন না। বিপদ আঁচ করতে পেরে মধুশ্রী জোর করে গাড়ি থেকে নামার চেষ্টাও করেন। তখন বাধা দেন অমিতাভ। পুলিশ জানিয়েছে উদ্ধার হওয়া তরুণী তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, গাড়ির মধ্যেই অমিতাভ তাঁর শ্লীলতাহানি করেন। বাধা দিলে মারধর করতে থাকেন। তখন ওই দম্পতি দেখতে পান। তাঁরা উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। সেই সময়েই ওই দম্পতিকে দেখে অমিতাভ তরুণীকে গাড়ি থেকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখনই অভিযুক্ত অমিতাভ ধাক্কা মারে নীলাঞ্জনাকে। গাড়ির ধাক্কায় পা ভাঙে নীলাঞ্জনার। অভিযুক্ত অমিতাভকে পাকড়াও করতে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ।