কলকাতার শীতের আমেজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা ধরনের মেলাও। কিছু মেলা শেষ হয়েছে, চলছে কিছু। কিন্তু সেই সব মেলায় অন্য বারের মতো মানুষের ঢল নেই। ফল, এক দিকে মুষড়ে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। অন্য দিকে মাথায় হাত রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিল্পী-কারিগরদের। অন্য বার এই মরসুমে যাঁরা সাত-আটটি মেলায় অংশ নিতেন, তাঁরাই এ বার মাত্র দু’তিনটি মেলা করে ফিরে যাচ্ছেন। সৌজন্য, খুচরোর আকাল।
হস্তশিল্পীদের উৎসাহ বাড়াতে মাটি উৎসব শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মিলনমেলা প্রাঙ্গণে হস্তশিল্প মেলার প্রবেশমূল্যও তুলে দিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি শেষ হয়েছে সেই মেলা। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে সবলা মেলাও শেষ। ৫০০, ১০০০ টাকার সমস্যার জন্য বেচাকেনা ধরে রাখতে এই দুই মেলায় পেটিএম এবং কার্ডে দাম মেটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। কারণ, প্রত্যন্ত জেলা থেকে যে শিল্পীরা আসছেন, অনেকেই কার্ডে বিক্রিবাট্টাতে অভ্যস্ত নন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার হস্তশিল্পী নয়ন চৌধুরীর কথায়, ‘‘অল্প দামের ছোট-ছোট জিনিস কে পেটিএম বা কার্ডে কিনবে? তাই এ বার মেলায় আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।’’
এখন সায়েন্স সিটিতে চলছে মেগা ট্রেড ফেয়ার। সাউথ সিটি মলের সামনে চলছে খাদি মেলা, করুণাময়ীতে সরস মেলা। এ ছাড়া মেলা চলছে দমদমেও। কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হবে বইমেলা, বিধাননগর মেলা, দমদম খাদ্যমেলা। অন্য বার প্রায় সব মেলাতেই টেরাকোটার সামগ্রীর স্টল দেন ঠাকুরনগরের আশিস বিশ্বাস। এ বার হস্তশিল্প মেলায় বেশ ক্ষতি হয়েছে তাঁর। আগে থেকে স্টল নেওয়া ছিল বলে বাধ্য হয়ে মেগা ট্রেড ফেয়ার আর খাদি উৎসবে স্টল দিতে হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বেচাকেনার হাল করুণ।
আশিসবাবুর কথায়, ‘‘বেচাকেনা নেই, কী করে মেলায় যাব?’’ কার্ডে দাম মেটানোর প্রসঙ্গ তুলতে তাঁর জবাব, ‘‘সেখানেও দীর্ঘ লাইন। মাঝে মধ্যেই লিঙ্ক চলে যাচ্ছে। আবার একশো, দেড়শো টাকার জিনিস কিনে ২ হাজার টাকার নোট ধরাচ্ছেন ক্রেতারা।’’
দক্ষিণ দমদম পুর এলাকার শূরের মাঠে ‘দমদম মেলা’র বেশ কিছু স্টল এখনও ফাঁকা। উদ্যোক্তারা জানালেন, স্টলের বিক্রিতেই ২০ দিনের মেলার খরচা ওঠে। এ বার বেশ কিছু স্টল ফাঁকা থাকায় টান পড়ছে তহবিলেও। মেলার আহ্বায়ক, দক্ষিণ দমদম পুরসভার কাউন্সিলর প্রবীর পাল বলেন, ‘‘অন্য বার মেলা শুরুর আগেই সব স্টল বিক্রি হয়ে যায়। এ বার ১০০টি স্টলের মধ্যে এখনও ফাঁকা ৪০টি।’’ উদ্যোক্তাদের তরফে জানা গিয়েছে, গত বছর ‘দশ বাই দশ’-এর একটা স্টল বিক্রি হয়েছে ৫০ হাজার টাকায়। এ বছর ৩০ হাজারেও তা বিক্রি করা যাচ্ছে না।
১২ বছর ধরে দমদম মেলায় স্টল দিচ্ছেন চন্দ্রনাথ পাল। তিনি জানালেন, ব্যাঙ্ক থেকে এক বারে বেশি টাকা মিলছে না। তার উপরে অন্য বারের মতো দাম দিয়ে স্টল কিনে যদি বিক্রিই না হয়, তবে পুরোটাই লোকসান। এক উদ্যোক্তা বলছেন, ‘‘এত দিনের মেলা তো বন্ধ করে দিতে পারি না। তাই মেনে নিতে হচ্ছে।’’
যে সব মেলা শুরু হয়নি, তাদের উদ্যোক্তারাও পড়েছেন সমস্যায়। দমদম খাদ্যমেলা ‘নালে ঝোলে’র আহ্বায়ক, দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান-পারিষদ দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘দরকারেও টাকা তুলতে পারছি না। কিন্তু ডেকরেটর, ইলেক্ট্রিশিয়ান— সবাইকে তো মেটাতে হবে নগদেই। বাধ্য হয়ে ধার নিয়ে কাজ করছি।’’ তিনি জানান, প্রচারেও কাটছাঁট করে অন্য বারের চেয়ে অর্ধেক গেট ও ফ্লেক্স করা হচ্ছে।