প্রতি বারই বড়সড় ঝড়-ঝঞ্ঝার পরে উপড়ে পড়া গাছ সম্পর্কে তথ্যগত ঘাটতি থাকে। —ফাইল চিত্র
ভীমরুলের চাকে ঢিল, না কি শাপে বর?
আমপানে ভেঙে বা উপড়ে পড়া গাছের হদিস জানতে মুখ্যমন্ত্রীর রিপোর্ট তৈরির নির্দেশের পরে এই প্রশ্নই ঘোরাফেরা করছে প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের মধ্যে। কারণ, এর সূত্র ধরে এক দিকে পরিবেশ সংক্রান্ত একাধিক অনিয়ম সামনে আসতে চলেছে বলে মনে করছেন তাঁরা। অন্য দিকে, পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য-ঘাটতি পূরণের ক্ষেত্রেও মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অন্যতম প্রাথমিক ধাপ হয়ে উঠতে পারে বলে তাঁদের আশা।
পরিবেশবিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, আগামী কাল বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম—‘ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন’ বা বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মুখ্যমন্ত্রীর এই নির্দেশ। এক পরিবেশবিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘কী হারিয়েছি, তার একটা হিসেব জরুরি।’’
প্রতি বারই বড়সড় ঝড়-ঝঞ্ঝার পরে উপড়ে পড়া গাছ সম্পর্কে তথ্যগত ঘাটতি থাকে। ধোঁয়াশা থাকে গাছ রোপণ সংক্রান্ত তথ্যেও। যার পিছনে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক নেতৃত্বের একাংশের ‘ইচ্ছাকৃত ঢিলেমি’ এবং ‘অভিসন্ধি’ জড়িয়ে থাকার অভিযোগ ওঠে আকছার। আমপানের পরেও তা উঠেছে।
কলকাতা পুর এলাকার ক্ষেত্রে উপড়ে পড়া গাছ নিয়ে বৃহস্পতিবারই একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। পুরসভা সূত্রের খবর, রিপোর্টে আমপানের সময়ে উপড়ে পড়া মেহগনি গাছ যেগুলি বর্তমানে দেশবন্ধু পার্ক, ৯ নম্বর বরো অফিস চত্বর, যোধপুর পার্ক ও পার্ক সার্কাস ময়দানে রাখা রয়েছে— তার উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি পুরকর্তাদের একাংশ এই প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক পুর ইতিহাসে করা প্রথম গাছ-গণনার রিপোর্টেরও উল্লেখ করছেন। তথ্য বলছে, পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে শুরু হওয়া ওই গণনায় ৬ ও ৮ নম্বর বরো এলাকা মিলিয়ে গাছের মোট সংখ্যা ১৯,৪৫২। পৃথক ভাবে ৬ এবং ৮ নম্বর বরোয় গাছের সংখ্যা যথাক্রমে ৫,৩৮৪ এবং ১৪,০৬৮।
তবে ওই দুই বরোয় তিন দশক আগে কত গাছ ছিল, সেই সংখ্যা রয়েছে কি?
এক পুরকর্তার বক্তব্য, ‘‘এই হিসেব কলকাতা পুরসভা বা বন দফতর, কারও কাছেই নেই!’’ আর এই ‘না থাকা’ই পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশবিজ্ঞানীদের একাংশ। ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এর (আইআইএসসি) এক সমীক্ষা অবশ্য জানাচ্ছে, নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় সবুজের পরিমাণ ছিল ২৩.৪ শতাংশ। আড়াই দশক পরে তা হয়েছে ৭.৩ শতাংশ। উল্টো দিকে, কংক্রিটের রাজত্ব বেড়েছে প্রায় ১৯০ শতাংশ! রিপোর্ট বলছে, ২০৩০ সালে শহরে সবুজের সম্ভাব্য পরিমাণ দাঁড়াবে মাত্র ৩.৩৭ শতাংশ! আবার কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বছর ৩৫ আগে শহরে পুকুর ও জলাশয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে আট হাজার। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন হাজারে। পরিবেশবিদ মোহিত রায়ের কথায়, ‘‘বর্তমানে যত পুকুর ও জলাশয় রয়েছে, তার সংরক্ষণ ঠিক মতো হলে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে।’’
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জ ঘোষিত ‘বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার দশক’-এ (২০২১-২০৩০) বিশ্ব জুড়ে অবনমন হওয়া ৩৫ কোটি হেক্টর স্থলভাগ ও জলজ বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলা হচ্ছে। আরও বলা হচ্ছে, এর ফলে ১৩-২৬ গিগাটন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে ফেলা সম্ভব। কিন্তু সেখানেও কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অপর্যাপ্ত তথ্যের বিষয়টি। পরিবেশবিজ্ঞানী তপন সাহা বলেন, ‘‘নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে পাওয়া উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করে তবু হারিয়ে ফেলা সবুজ বা জলাশয়ের ধারণা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তার আগের তথ্য অধরাই থাকছে।’’
এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ তথ্য-ঘাটতি পূরণের প্রাথমিক ধাপ হয়ে উঠবে কি না, আপাতত সে দিকেই তাকিয়ে অনেকে।