আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত নাগরিক-মিছিল। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
‘মাননীয় অফিসার ইনচার্জ। টালা থানা। কলকাতা পুলিশ কমিশনারেট।’ এর পরে দেড় পাতার লিখিত অভিযোগ।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় এ বার সামনে এল পরিবারের করা সেই অভিযোগপত্র। যার ভিত্তিতে পরে টালা থানার পুলিশ এফআইআর রুজু করে বলে দাবি। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য নানা বিষয়ের মতো এই অভিযোগপত্র ঘিরেও প্রশ্ন অনেক। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হল, এই অভিযোগপত্রে লেখা নেই কোনও সময়। অর্থাৎ ঠিক কখন, পরিবারের তরফে এই অভিযোগপত্র পুলিশের কাছে জমা করা হয়েছে, তার উল্লেখ করা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, মৃতার বাবার সই করা এই অভিযোগপত্রটি কে লিখেছেন। প্রশ্ন আছে লেখার বয়ান নিয়েও। সূত্রের খবর, যা নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে খোদ সিবিআই-ও। তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বয়ান লেখককেও। তাঁর হাতের লেখাও মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।
অভিযোগপত্রে দেখা যাচ্ছে, ঘটনা পরম্পরা জানিয়ে লেখা হয়েছে, ‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা ব্যানার্জী এবং কলকাতা পুলিশের মাননীয় নগরপাল শ্রী বিনীত গোয়েল স্যর আমাদের কথা দিয়েছেন, এর সুবিচার পাব। প্রশাসন ও সরকারের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে পুনরায় অনুরোধ করছি, দয়া করে সন্তানহারা এই বাবার আবেদন মান্যতা দেবেন’। লেখার শেষে ডান দিকে মৃতার বাবার নাম লেখা। তার নীচে লেখা মৃতার বাবার মোবাইল ফোন নম্বর। তার বাঁ দিকে লেখা, ৯ অগস্ট ২০২৪। ওই দিনই সামনে এসেছিল আর জি করের ঘটনা। কিন্তু সেখানে কোনও সময়ের উল্লেখ নেই।
অভিযোগপত্রটিতে আরও দেখা যাচ্ছে, শেষে এবং শুরুতে পুলিশের স্ট্যাম্প বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সই করেছেন এক পুলিশকর্মী। কিন্তু সেখানেও কোনও সময় উল্লেখ করা হয়নি। এই খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বার বার উঠে এসেছে আদালতের পর্যবেক্ষণে। সুপ্রিম কোর্টও জানতে চেয়েছিল, সকাল ১০টা ১০ মিনিটে যেখানে পুলিশ মৃতদেহের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, সেখানে কেন রাত পৌনে বারোটায় গিয়ে এফআইআর রুজু করা হল? কেন সুরতহাল থেকে ময়না তদন্তের সমস্ত কিছুই করা হল একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা বা ইউডি কেসের ভিত্তিতে?
যুক্তি হিসেবে কলকাতা পুলিশ দাবি করেছে, পরিবারের তরফ থেকে অভিযোগ পাওয়ার অপেক্ষা করা হচ্ছিল। সেটা পাওয়ার পরই, রাত পৌনে বারোটায় ওই অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে এফআইআর রুজু করা হয়েছে। যদিও অনেকেরই প্রশ্ন, এমন গুরুতর ঘটনায়, যেখানে মৃতদেহ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে খুনের ঘটনা, সেখানে অভিযোগ পাওয়ার জন্য কেন অপেক্ষা করবে পুলিশ? তবে কি পরিবার অনেক দেরিতে অভিযোগ জমা করেছিল? আইনজীবীদের দাবি, সময়ের উল্লেখ না থাকায় অভিযোগপত্র থেকে সেই উত্তর পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে সিবিআই সূত্রে খবর, তারা মনে করছে, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। তারা এখন জানতে চাইছে, এটা কি তাড়াহুড়োয় সময় লিখতে ভুলে যাওয়ার মতো ব্যাপার? না কি এর পিছনে রয়েছে অন্য কোনও রহস্য?
এর মধ্যে চিকিৎসক পড়ুয়ার মৃতদেহ তড়িঘড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে তাঁর পরিবার। মৃতার মা এ দিনও বলেছেন, ‘‘আমি তো টালা থানায় গিয়ে বসে ছিলাম। মৃতদেহ থানায় না আনলে আমি যাব না বলেছিলাম। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে আমাদের কিছু না জানিয়েই মেয়ের মৃতদেহ আমাদের বাড়ির দিকেই পাঠিয়ে দিয়েছিল পুলিশ। সব দিক থেকে অদ্ভুত রকম চাপ তৈরি করা হয়েছিল।’’ কী সেই চাপ? এর মধ্যেই সামনে এসেছে, সে দিন মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করার সময় জোর তদারকি শুরু করেছিলেন মৃতার ‘কাকু’ পরিচয় দেওয়া এক ‘প্রভাবশালী নেতা’। মৃতার বাবা-মা নন, শ্মশানের কাগজপত্রে এই ‘প্রভাবশালী নেতা কাকু’ই সই করেছিলেন বলে সামনে এসেছে। সেই সই করা কাগজ ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে ভাইরাল। এর মধ্যেই শ্মশানের কর্মীরা দাবি করেছেন, চিকিৎসক পড়ুয়ার মৃতদেহের আগে সেখানে আরও দু’টি মৃতদেহ ছিল। সেগুলিকে টপকে আগে চিকিৎসক পড়ুয়ার দেহ দাহ করে ফেলতে বলা হয় বলেই তাঁদের দাবি। এই নির্দেশ ওই নেতা-কাকু দেন বলে অভিযোগ। কোন উদ্দেশ্যে এই কাজ? ওই ব্যক্তি দাবি করেছেন, ‘‘আমি ওর (মৃতার) কাকুর মতো। পাশের বাড়িতেই থাকি। রাজনীতি করার সূত্রে কোভিডের সময়ে এই ভাবে প্রচুর মৃতদেহ শ্মশানে দাহ করিয়ে দিয়েছি। কই, তখন তো কেউ প্রশ্ন তোলেননি! আমি শ্মশানে সই করে থাকলে সমস্যা কোথায়?’’
যদিও অভিযোগ, শুধু শ্মশানের কাগজে সই করাই নয়, মৃতার পরিবারের তরফে এই যে অভিযোগপত্র পুলিশের কাছে জমা করা হয়েছে, তা-ও লিখেছেন স্বয়ং এই কাকুই। ফলে চিঠির বয়ানে মুখ্যমন্ত্রীর নাম এবং ‘প্রশাসন ও সরকারের উপর পূর্ণ আস্থা’ রাখার বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে লেখা কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। অনেকেই জানতে চাইছেন, সরকারি হাসপাতালে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় প্রশাসনিক দায় নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বুঝেই কি সরকারি নথিতে এমন বয়ান লিপিবদ্ধ করানো হয়েছিল, যাতে মনে হয়, সরকারের উপর মৃতার পরিবারের আস্থা রয়েছে? তারই অঙ্গ হিসাবে কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বাদ দেওয়া হয়েছিল সময়ের উল্লেখ? খোঁজ করছে সিবিআই-ও।
সূত্রের খবর, থানায় লেখা চলাকালীন ‘প্রভাবশালী নেতা কাকু’-র এই বয়ানের বিরোধিতা করেছিলেন মৃতার বন্ধু। সেখানে তখন ওই বন্ধুর বাবা-মা-ও উপস্থিত। মৃতার বন্ধু এক আইনজীবীও নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে ওই আইনজীবীকে অভিযোগপত্র লিখতে দেওয়া হয়নি। আইনজীবী এমন বক্তব্য না লেখার অনুরোধ করলেও নেতা-কাকুর দাপটে তা টেকেনি বলে এক প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি।
মৃতার মা এ দিন বলেন, ‘‘যখন হাসপাতালে মেয়ের ময়না তদন্ত চলছে, সেই সময়েই ওই সাড়ে ছ’টা-সাতটা নাগাদ থানায় এই লেখা লেখানো হয়েছে। আমি তখন হাসপাতালে। ওর (মৃতার) বাবাকে সিবিআই সবটা জিজ্ঞেস করেছে।’’