অপরূপ: মন্দিরের অন্দরসজ্জা। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
বৌবাজারের ট্রাম রাস্তার ধারে চশমার দোকানের গলতা ধরলে দু’-দশ পা। তাই একটু বেড়িয়ে ঘুরপথ ধরা যাক!
লালবাজারের উল্টো দিকে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট লাগোয়া গ্র্যান্ট লেন ধরে এঁকেবেঁকে আসুন। আরও ভাল হয়, মিশন রো মানে গণেশ অ্যাভিনিউয়ের সাবেক চিনে রেস্তোরাঁর উল্টো ফুটের গলিটা ধরলে।
টাইম মেশিনে সওয়ার হয়ে অন্য যুগে ডুব দেওয়ার আগে মানিয়ে নিতে বেশি সময় পাবেন। গণেশ অ্যাভিনিউ লাগোয়া ঘিঞ্জি নোংরা গলিপথটাই মেটকাফ স্ট্রিট। আঁকাবাঁকা সড়কের শেষটাই বৌবাজারের ট্রাম রাস্তায় মিলেছে। একেবারে শেষ প্রান্তে পার্সি মন্দির বা এলাকার লোকের ভাষায় ‘পার্সি গির্জা’! কম্পিউটার কলকব্জার দোকান, ভাত-ডাল-কাবাবের ঠেক, মুড়িওয়ালার কাছে খোঁজ করলে খুব সপ্রতিভ জবাব না-ও পেতে পারেন। কারণ, ৯১ নম্বর মেটকাফ স্ট্রিটে জরাথ্রুষ্টবাদীদের উপাস্য অগ্নিদেবতা সদা জাগ্রত থাকলেও দিনভর ভক্তসমাগম ততটা সম্ভব নয়। অগস্টে পার্সিদের নববর্ষ, মার্চের বসন্ত উৎসব-টবে সামান্য ভিড়। বিক্ষিপ্ত পারিবারিক আচার ছাড়া মন্দিরের অছি নিযুক্ত গুটিকয়েক কর্মী, পার্সিদের পূজারী বিশেষ ধরনের টুপিধারী মোবেড বা দস্তুরদের শুধু দেখা মিলবে।
সাদা ধবধবে প্রাসাদগোছের ভারিক্কি বাড়ির বাহারি লোহার গেট নইলে বন্ধই থাকে। ভিতরের ঝকঝকে উঠোনটিতে কিন্তু মালুম হয় শতবর্ষ পার করা মন্দিরের ট্রাস্টের রেস্ত নেহাত কম নয়। কলকাতার কয়েকশো পার্সি-র ধর্মকর্মের সবেধন নীলমণি মন্দিরটির নিত্য যত্নের অভাব হয় না। একতলার উঠোনে প্রহরী কলকাতার এক শতকের সাক্ষী বিলিতি ঠাকুরদা ঘড়ি ও দেওয়ালে খোদাই লম্বা দাড়ি, ডানামেলা জোব্বাধারী এক বুড়ো।
এই বৃদ্ধই পার্সি ধর্মের ‘গার্ডিয়ান এঞ্জেল’! তাঁর নাম, ফারাহভার। মুম্বই থেকে বছর চারেক আগে কলকাতায় বদলি, মন্দিরের সেজ পূজারী এরভাড ব্যায়রাম কারনজিয়া জামার বোতাম খুলে দেখালেন, পার্সিদের প্রায় সক্কলের গলার মাদুলিতে ডানামেলা বুড়োর ছোঁয়া। তাঁর ডানার খোপকাটা তিন ভাগে পার্সি ধর্মের মূল সুর, ভাল ভাবা, ভাল বলা, ভাল করা-র প্রতীক। যিশুর দেড়-দু’হাজার বছর আগের সুপ্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি এ ভাবেই মিশেছে কলকাতার মন্দিরে।
দোতলায় উপাসনা কক্ষে সেই ১৯১২ থেকে অক্লান্ত জ্বলছে অগ্নিকুণ্ড। আগুনের সামনে অবশ্য ভিন-ধর্মী কারও যাওয়ার অনুমতি নেই। তবে বাইরে ঘষা কাচের অপরূপ নকশায় চোখ জুড়িয়ে যায়। রঙিন ঘষা কাচেই দৃশ্যমান সৃষ্টিকর্তা আহুরা মাজদা, প্রফেট জরাথ্রুষ্ট, পশুপাখি, উদ্ভিদকুল, আকাশ, মাটি ইত্যাদির প্রতিনিধি এক-একটি দিব্যমূর্তি। মুম্বইয়ে গোটা ৫০ অগ্নিদেবতার মন্দির থাকলেও কলকাতায় এই একটিই।
মন্দির ট্রাস্টের ম্যানেজার কেটি রুসি কাপাডিয়া হিসেবনিকেশ বা মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণেই সদাব্যস্ত। আদতে জামশেদপুরের মেয়ে কেটি বলছিলেন, ‘‘পশ্চিম ভারত থেকে কলকাতায় ভাগ্যের খোঁজে আসা পার্সিদের এক সময়ে ‘বেঙ্গলি’ পদবী নেওয়া রেওয়াজ ছিল। আমার বাপের বাড়িও ‘বেঙ্গলি পার্সি’!’’ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ধুনজীভাই বেহরামজী মেটা ও তস্যপুত্র রুস্তমজী ধুনজীভাই বেহরামজী মেটা উনিশ শতক ও বিশ শতকের গোড়ার দিকের কলকাতার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তার আগে এজরা স্ট্রিটে ছোটখাটো বা অস্থায়ী মন্দির ছিল অগ্নিদেবতার।
মেটকাফ স্ট্রিটের অংশটিতে পার্সি মন্দির, শিয়া ইস্মাইলি মুসলিমদের জামাতখানা ও আবছা চিনে অক্ষর সর্বস্ব এক বন্ধ ইটিং হাউজ মিলে অদ্ভূত ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে। একদা উপমহাদেশের রাজধানী শহরে ছাপ ফেলত পাঁচমিশেলি জনতার নানারঙা জীবন। কলকাতার এই গলির কোণ চুপটি করে সেই স্মারক বহন করছে।