পরেশ পাল ও প্রকাশ উপাধ্যায়
পাঁচটা বছর পুরসভায় মেয়রকে স্বস্তিতে থাকতে দেননি তিনি। এমনকী সারদা কেলেঙ্কারিতে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়েরও ‘হাত’ রয়েছে এমন অভিযোগ তুলে বার কয়েক ছুটেছেন সল্টলেকের ইডি, সিবিআইয়ের দফতরেও। পুর-অধিবেশনেও মেয়রকে ‘কটু’ কথা শোনাতে দ্বিধা করেননি। তিনি প্রকাশ উপাধ্যায়। কলকাতা পুরসভার ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস কাউন্সিলর। ভোট-যুদ্ধে তিনি ফের অবতীর্ণ রাজাবাজার সংলগ্ন ওই ওয়ার্ডে। তবে এ বার তাঁকে আর পুরসভায় দেখতে চান না মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। ঘনিষ্ঠ মহলে মেয়র জানিয়েছেনও, প্রকাশ ‘বধ’ই তাঁর লক্ষ্য। আর তাই বেলেঘাটার বিধায়ক তৃণমূলের জাঁদরেল নেতা পরেশ পালকে সেখানে প্রার্থী করেছে দল। সাংগঠনিক দিক থেকে শহরের ভোটে কংগ্রেস যখন অনেকটা দুর্বল, তখন রাজাবাজারের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় সেই দলেরই এক প্রার্থীর ‘পরাক্রম’ নজর কাড়ছে শহরবাসীর।
আর প্রকাশের ‘পরাক্রম’ রুখতেই নাম ঘোষণার পরদিন থেকে ‘সৈন্য-সামন্ত’ নিয়ে রাজাবাজারের নারকেলডাঙা নর্থ রোডে নোঙর গেড়েছেন ফুলবাগানের স্থায়ী বাসিন্দা পরেশ পাল। ২৯ নম্বর ওয়ার্ড তাঁর বিধানসভা এলাকাতেই। তাই বিধায়ক হিসেবে সেখানকার উন্নয়নে যে কাজ করেছেন, সে সবই তাঁকে ‘ডিভিডেন্ড’ দেবে বলে মনে করছেন পরেশ। পুর-পরিষেবার নিরিখে পুরভোট হলেও সংখ্যালঘু এই এলাকার ‘অন্য’ অঙ্কও রয়েছে। গত পুরভোটে এখানে প্রকাশবাবু জিতেছিলেন শ’তিনেকের মতো ভোটে। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন বাম প্রার্থী চিকিৎসক সুবোধ দে। তৃণমূল তৃতীয়। বাম প্রার্থীর সঙ্গে তৃণমূলের ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ২০০। হারার কারণ হিসেবে তৃণমূলের ব্যাখ্যা ছিল, মহম্মদ হানিফ নামে এক নির্দল প্রার্থীর প্রায় আড়াই হাজার ভোট টানাই এর প্রধান কারণ। আর সেই লক্ষ্যেই নাম ঘোষণার ঠিক আগে রাজাবাজারে গিয়ে হানিফকে নিজের দলে ঢুকিয়ে নেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। পরে সেই প্রসঙ্গ তুলে বলেওছিলেন, ‘‘এ বার দেখে নেব প্রকাশকে।’’
রবিবার সন্ধ্যায় পরেশের নির্বাচনী অফিসে ছিলেন হানিফও। বললেন, ‘‘আমাকে যাঁরা ভোট দিয়েছিলেন, এ বার তাঁরা পরেশদাকে সমর্থন করবেন।’’ কেন?
হানিফের জবাব, ‘‘বিধায়ক পরেশদা রাস্তা, নিকাশি নালা, শৌচালয় করেছেন। রাজাবাজার ব্রিজের কাছে মাটির নীচ দিয়ে একটা সাবওয়ে-ও করেছেন। এ সবই এলাকাবাসী জানেন।’’ প্রায় ৪৪ হাজার ভোটার ২৯ নং ওয়ার্ডে। যার প্রায় ৭৫ শতাংশ মুসলিম। প্রকাশের কথায়, ‘‘ওঁরাই আমার তুরুপের তাস।’’ কারণ জানতে চাইলে প্রকাশের বক্তব্য, ‘‘সব সময়ে ওঁদের পাশে থাকি। কোনও কাজ থাকলে ওঁরা আমার কাছে ছুটে আসেন।’’ আর তাঁর ওই দাবি যে সঙ্গত, তা বোঝাতে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই ওয়ার্ডের ফলাফলের কথা তোলেন প্রকাশ।
প্রসঙ্গত, ২০১৪-র লোকসভায় এই ওয়ার্ডে কংগ্রেস প্রার্থী তৃণমূলের থেকে প্রায় ৪ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল। তবে প্রকাশবাবুর ওই হিসেব ওলটপালট হয়ে যাবে বলে জানান পরেশ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সে তো বিজেপিকে হারানোর জন্য সংখ্যালঘুরা কংগ্রসকে সমর্থন জানিয়েছিল। পুরভোটের সঙ্গে তা মিলবেই না।’’ একই ধারণা বাম প্রার্থী ফরওয়ার্ড ব্লকের চিকিৎসক সুদীপ্তা দাসের। এই এলাকার এক সময়ের কাউন্সিলর সুবোধ দে-র মেয়ে তিনি। এলাকার উন্নয়নে বাবার অবদানই তাঁর প্রচারের প্রধান অস্ত্র।
রাজাবাজারের অলিগলি ব্যানার পোস্টারে ছয়লাপ। অহরহ ঘুরছে যুযুধান দুই প্রধান প্রতিপক্ষের মিছিলও। জঞ্জাল সাফাই নিয়মিত হয় বলে দাবি করা হলেও তেমনটা চোখে পড়েনি। তবে পানীয় জল সরবরাহ নিয়ে অভিযোগ কম। এলাকার বাসিন্দার একাংশের কথায়, বর্তমান কাউন্সিলর কাছেই থাকেন। তাই বিপদে-আপদে তাঁকে কাছে পাওয়া যায়।’’ অন্য দিকে, আর একটি অংশের বক্তব্য, ‘‘পুর-প্রশাসন যাঁর দিকে থাকবে, উন্নয়ন তো তাঁদের মাধ্যমেই হবে।’’ এ প্রসঙ্গে পরেশ পালের উদ্যোগে জলাশয় ঘিরে তৈরি একটি পার্ক নজর কেড়েছে অনেকেরই। আবার এলাকার মানুষের হেঁশেলে ঢুকে পড়া প্রকাশও পাল্লা দিচ্ছেন সমানে। অর্থবল, লোকবলে বলীয়ান পরেশকে রোখা যে কঠিন, তা মনে মনে বুঝছেন প্রকাশও। তবুও বলছেন, ‘‘আমার পিছনে আছে জনস্রোত।’’ অন্য দিকে, ওই ওয়ার্ড মেয়রকে ‘ভেট’ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ‘সেনাপতি’ পরেশ পাল।