মুখোমুখি: সল্টলেকের আড্ডাঘরে। বৃহস্পতিবার। ছবি:শৌভিক দে
রূপান্তরকামী কারা? মানসিক নাকি শারীরিক, কোন দিক থেকে আলাদা তাঁরা? বিয়ে, সন্তানধারণ, স্বাভাবিক জীবনযাপন কতটা সম্ভব তাঁদের পক্ষে? ৩৭৭ ধারা বাতিলের পরেও রূপান্তরিত হওয়ার ইচ্ছে বাস্তবায়িত করতে কতটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয় ওই নারী-পুরুষদের? এই প্রশ্নগুলির উত্তর অনেক সময়েই ঠিক ভাবে জেনে উঠতে পারেন না প্রবীণেরা। তাই রূপান্তরিত হতে চাওয়া ওই মানুষগুলির প্রতি সহানুভূতিশীলও হতে পারেন না কেউ কেউ। সেই অজ্ঞানতা কাটিয়ে বন্ধু হতেই বৃহস্পতিবার সল্টলেকে এক আড্ডায় শহরের রূপান্তরকামীদের একাংশ মিলিত হলেন প্রবীণদের সঙ্গে।
পেশায় আইনজীবী, রূপান্তরকামী মেঘ সায়ন্তন ঘোষের এক বর্ষীয়ান আত্মীয়ারই তাঁর পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সায়ন্তনের মায়ের কাছে সেই আত্মীয়া জানতে চেয়েছিলেন, ‘ও মেয়ে হতে চায় কেন? এটা কি ওর অসুখ?’ তার পরেই সায়ন্তনের মনে হয়, নিজেদের ‘পরিচয়’ নিয়ে প্রবীণদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রবীণদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত সল্টলেকের ওই আড্ডাঘরে অবশ্য উপস্থিত প্রবীণদের অনেকের গলাতেই শোনা গেল গ্রহণযোগ্যতার সুর। ঋতুপর্ণ ঘোষ-চপল ভাদুড়ীকে স্মরণ করে সত্তরোর্ধ্ব তৃপ্তি চক্রবর্তী দৃপ্ত গলায় বলেন, ‘‘মহাভারতের চিত্রাঙ্গদাকে যদি আমরা গ্রহণ করতে পারি, তা হলে এই রূপান্তরকামীদেরই বা নয় কেন!’’ সল্টলেকের বাসিন্দা রতীশরঞ্জন ভট্টাচার্য আবার বলছেন, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গ বলে দেগে দিলে এঁদের অপমান করা হয় বলে মনে হয়। অচ্ছুত নয়, ওঁরা তো আমাদেরই এক জন।’’ স্মৃতি হাতড়ে তিনি শোনালেন তাঁর ছেলেবেলার এক মেয়ে বন্ধুর গল্প, যাঁর ছেলে হওয়ার ইচ্ছে ছিল প্রবল। যে ইচ্ছের কারণে বাবা-মায়ের কাছে কম হেনস্থার শিকার হতে হয়নি সেই বান্ধবীকে। নিজের
জন্মদিনে নবতিপর এই বৃদ্ধের উপলব্ধি, ‘‘তখন ছোট ছিলাম, বন্ধুর কষ্ট ঠিক বুঝতে পারতাম না। আজ ওর কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে।’’ সত্তর বছরের অভিজিৎ সেনগুপ্তের আবার মনে পড়েছে তাঁর এক সহপাঠীর কথা, যে ছিল ‘অন্য রকম’। অভিজিৎবাবুর কথায়, ‘‘এক দিন খেলার মাঠে কথা বলে বুঝেছিলাম, আর পাঁচ জন যে ভাবে ওর সঙ্গে আচরণ করত, তা ও মেনে নিয়েছিল। সেটা খারাপ লেগেছিল। সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো সত্যিই কঠিন।’’
তবে সমাজেরও আগে পরিবারের মানসিকতার বদল ঘটানো যে জরুরি, তা এক বাক্যে জানাচ্ছেন সায়ন্তন-প্রকাশেরা। একাদশ শ্রেণির ছাত্র, রূপান্তরকামী প্রকাশ ছলছল চোখে বলে, ‘‘আমার এক আত্মীয় ছিল, আমারই মতো। স্কুল পালিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের জামাকাপড়, সাজগোজের জিনিস পরতাম আমরা দু’জনে। জানাজানি হতে সেই ছেলেটিকে হস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওর বাবা-মা বুঝতেও চাননি যে ও কী চায়। এক বছর আগে বন্ধুর ফোনে খবর এল, ও আত্মহত্যা করেছে। তখন ও সবে নবম শ্রেণি!’’ আড্ডাঘর তখন নিস্তব্ধ।
তাই ‘প্রান্তিক’ অথবা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলে দেগে দিয়ে নয়, ভালবেসে কাছে টেনে নিয়েই যে তাঁরা রূপান্তরকামীদের লড়াইটা একটু সহজ করে দিতে চান, এ দিন সেই বার্তাই দিলেন এ শহরের প্রবীণেরা।