ভরসন্ধ্যায় অরবিন্দ সরণি, গ্রে স্ট্রিট হয়ে গাড়ির লম্বা লাইন চলে গিয়েছে কিছুটা দূর পর্যন্ত। যানজটে চাকা যেন নড়ছেই না! কিছুটা এগিয়ে দেখা গেল, সামনে বিসর্জনের ঘাটের দিকে যাওয়ার জন্য পর পর প্রতিমার লাইন। তারই একটি চলছে সব চেয়ে ধীরে। সেখানে বিশাল ট্রেলারে বসানো প্রতিমার আগে মাঝারি আকারের আরও একটি লরি। সেটির গায়ে বাঁধা হয়েছে বিশাল কয়েকটি সাউন্ড বক্স। রয়েছে রকমারি আলোর স্ট্যান্ড। যেন চলন্ত ‘ডিস্কোথেক’!
সেই লরির পিছনেই উদ্দাম নাচে ব্যস্ত অনেকে। বক্সের তীব্র আওয়াজে কানে তালা লাগার অবস্থা। নাচতে নাচতে কেউ কারও গায়ে পড়ছেন, কেউ শুয়ে পড়ছেন রাস্তায়! পাশে পাশে হাঁটতে থাকা পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায়। পুলিশ শুধু ব্যস্ত আশপাশের চলন্ত গাড়ি থামাতে। গাড়ি চলার জায়গা দেওয়ার কথা বলতেই ওই পুজো কমিটির এক কর্তা বললেন, ‘‘সারা বছর তো তাড়াতাড়ি বাড়ি যান। আজ নাচ দেখুন না!’’ বলেই তাঁর চিৎকার করে নির্দেশ, ‘‘আরও জোরে গান বাজা।’’ আওয়াজ বেড়ে গেল কয়েক গুণ!
বুধবার কালীপুজোর বিসর্জন ঘিরে এমনই দৃশ্য দেখা গেল শহরের নানা জায়গায়। যা কালীপুজো এবং দীপাবলির বিধিভঙ্গের চিত্রের চেয়ে কম নয় বলেই অভিযোগ প্রত্যক্ষদর্শীদের। পুলিশি নির্দেশ উড়িয়ে দেদার সাউন্ড বক্স যেমন বাজল, তেমনই চলল বিসর্জনের শোভাযাত্রার নামে হেলমেটহীন চালকদের মোটরবাইক র্যালি। কালীপুজো এবং দীপাবলির রাতের মতোই বিসর্জন ঘিরে বাজির দাপট চলল। যা দেখে অনেকেরই প্রশ্ন, বিসর্জনেও পুলিশ কেন কড়া হবে না?
পুরসভা সূত্রের খবর, এ দিন সব চেয়ে বেশি বিসর্জন হয়েছে বাবুঘাটে। এর পরেই রয়েছে উত্তর কলকাতার ঘাটগুলি। বিসর্জনের শোভাযাত্রার জন্য রাতের দিকে আলাদা করে পুলিশি বন্দোবস্ত করতে হয় বিবেকানন্দ রোড এবং অরবিন্দ সরণিতে। গাড়ির চাপ ছিল রবীন্দ্র সরণির মতো বেশ কিছু রাস্তায়। এ বার প্রথমে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিসর্জনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কালীপুজো কমিটিগুলির সঙ্গে পুলিশের সমন্বয় বৈঠকে বিসর্জনের জন্য আরও একটি দিন বাড়ানোর কথা ওঠে। সেই মতো শহরের বড় পুজোর প্রায় প্রতিটিরই শুক্রবার বিসর্জন হতে পারে বলে খবর। সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের নব যুবক সঙ্ঘের (ফাটাকেষ্টর পুজো) পুজোকর্তা সুকৃতি দত্ত বললেন, ‘‘শুক্রবারেই ধুমধাম করে বিসর্জন হবে। আমাদের বিসর্জনও মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখেন।’’ একই দাবি বৌবাজার ৪৮ পল্লি যুবশ্রীর কালীপুজোর কর্তা তথা বিধায়ক তাপস রায়ের। তিনি বললেন, ‘‘প্রচুর ঢাক নিয়ে ভাসান হবে। বহু মানুষ হাঁটবেন। ঢাকেই যা আওয়াজ হয়, আর অন্য কিছু লাগে না।’’
অরবিন্দ সরণির একটি আবাসনের বাসিন্দা সুমন গুহের অভিযোগ, ‘‘রাস্তার উপরে আমাদের বাড়ি। বাবার হার্টের সমস্যা রয়েছে। আমাদের এখান দিয়ে এতগুলো বিসর্জনের মিছিল যায় যে, রাতে ঘুমোনো যায় না।’’ বিবেকানন্দ রোডের স্নেহা কর্মকারের দাবি, ‘‘তাসার আওয়াজ আর বক্সের তাণ্ডবের জন্যই প্রতি বার আমাদের বয়স্ক মাকে এই সময়ে দিদির বাড়িতে রেখে আসি। এ বারেও বিকেল থেকে বিসর্জনের নামে বাজি ফেটে চলেছে।’’
একই রকম নিয়ম না মানার ছবি ধরা পড়েছে মাঝেরহাট সেতুর কাছেও। রাতে সেখানে একটি লরি থামায় পুলিশ। বিসর্জন-ফেরত সেই লরির মাথায় বিপজ্জনক ভাবে বসে ছিলেন কয়েক জন। দু’হাত ছেড়ে তাঁদের অনেকেই হাওয়া কাটার সময়ে আওয়াজ হয়, এমন বেলুন ধরে বসেছিলেন। এক পুলিশকর্মী জানতে চান, ‘‘জীবনের মায়া নেই?’’ উত্তর এল, ‘‘দু’বছর পরে এতটা মজা হচ্ছে। জীবনের মায়া করলে চলে?’’