জয়োৎসব। মঙ্গলবার, শহরে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
নিষেধের তোয়াক্কা না করেই শহর মেতে উঠল উৎসবের মেজাজে।
সোমবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, নেপালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে কোনও রকম বিজয়োৎসব পালন করবে না তাঁর দল। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে ফল ঘোষণা শুরু হতে না হতেই শহরের দখল নিলেন তৃণমূল সমর্থকেরা। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়াল যে, মুখ্যমন্ত্রীর নিজের এলাকা ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডেও তুমুল হট্টগোল হল রতন মালাকারের জয় উদ্যাপনে। কপালে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া স্টিকার সেঁটে উদ্দাম নাচ শুরু করলেন দলীয় সমর্থকেরা। বেরোল মিছিল, সঙ্গে বক্সে চটুল হিন্দি গান।
‘‘কিন্তু আপনাদের দিদি তো উৎসব করতে বারণ করে দিয়েছেন। সেই কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না?’’ প্রশ্নটা শুনে কয়েক মুহূর্ত থমকায় নাচতে থাকা চেহারাগুলো। তার পরেই সমস্বরে জবাব, ‘‘ওটা দিদির মনের কথা নয়। ভোটের জন্য এত খাটলাম। এখন একটু-আধটু ফুর্তি না করলে কি চলে?’’
একই রকম ‘ফুর্তি’র চেহারা ছিল দুপুরে। কবি নজরুল মেট্রো স্টেশনের গেট আটকে সবুজ আবিরের প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। দেদার আবির উড়ছে। মেট্রো স্টেশনে ঢুকতে-বেরোতে হলে সেই আবির মাখতেই হবে। আপত্তি করলেই জুটছিল গালিগালাজ। কোলে কয়েক মাসের শিশুকে আঁকড়ে থাকা কিংবা অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও সেই আক্রমণ থেকে বাদ যাচ্ছিলেন না। এখানেই শেষ নয়। আবিরের পাশাপাশি ফাটছিল চকোলেট বোমাও। স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অটো কিংবা পথচলতি মানুষদের তাক করে ছোড়া সেই চকোলেট বোমায় ত্রস্ত হচ্ছিল চারপাশ।
শহরের অন্য প্রান্তে তখন নাগেরবাজার থেকে দমদমগামী অটোয় হুড়মুড়িয়ে উঠছেন যাত্রীরা। চালক বারবার হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলেন, ‘‘তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। কখন কী শুরু হবে, কেউ জানে না।’’
কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ায় মাতোয়ারা সমর্থকেরা। মঙ্গলবার। ছবি: সুমন বল্লভ।
শুরু হতে অবশ্য দেরি হয়নি। রাস্তায় কয়েক হাত অন্তর ফাটতে শুরু করেছিল চকোলেট বোমা। অটোর ভিতরে কুঁকড়ে বসে থাকতে থাকতে যাত্রীরা ভাবছিলেন, বোমার হাত ধরে উৎসবের রেশ অটোর ভিতরেও পৌঁছে যাবে না তো?
এর আগে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির রাস্তায় ঢুকতেই পথ আটকান নস্যি রঙা সাফারি স্যুট পরা পুলিশকর্মী। ‘‘আর ঢুকবেন না। প্রেসকে এখানেই দাঁড়াতে বলেছে।’’ অতএব, মঙ্গলবার সকাল ন’টা নাগাদ সেখানেই আস্তানা গাড়লেন সাংবাদিক-আলোকচিত্রীরা।
ঠিক উল্টো দিকের রাস্তায় ঢুকতে বাঁ হাতে ‘কালীঘাট স্পোর্টস লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর ক্লাবঘরে তখনই তুমুল ভিড়। ভিতরে টিভিতে ভোটের ফল দেখা যাচ্ছে। দরজার বাইরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ল্যামিনেট করে বাঁধানো মাঝারি সাইজের ছবি। তলায় লেখা—‘তব চরণং কেবলম।’ পাশে কয়েক ছত্র কবিতা— ‘কী রূপে এলে মাগো/আগে কোথায় ছিল ধাম/মানব রূপে জনম নিলে/তুমি হয়ে ভগবান...’। এক-এক জন করে আসছেন, চটি খুলে ছবিতে প্রণাম করছেন, তার পরে খালি পায়ে ঘরে ঢুকে যাচ্ছেন। ভিতরে বসে মুখ্যমন্ত্রীর এক ভাই বাবুন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে ঘিরে সেখানে ঠাসাঠাসি ভিড়। এক-এক জন করে তৃণমূলপ্রার্থীর জেতার খবর আসছে, আর ফটাফট হাততালি-সিটি।
বেলা বাড়তেই একে-একে আসতে থাকলেন মহিলারা। সিঁথিতে-গালে সবুজ আবির, কপালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি সাঁটা, মাথায় ফেট্টির মতো বাঁধা তৃণমূলের পতাকা। এক জন শাড়ির কোঁচর থেকে কুচো ফুল নিয়ে আকাশে ছুড়ে দিচ্ছেন, সঙ্গে উত্তুঙ্গ উল্লাসে স্লোগান। এরই মধ্যে বাবুনবাবু বেরিয়ে এসে টিভি ক্যামেরার সামনে দু’আঙুলে ‘ভি’ দেখাতেই উচ্ছ্বাস নিমেষে বাঁধনছাড়া। পাশ থেকে এক মহিলা পুলিশকর্মী নিচু গলায় বলে ফেললেন, ‘‘বিজেপি-সিপিএম কিন্তু বেশ কয়েকটা সিট পেয়েছে কলকাতায়।’’ শুনেই প্রমিলা বাহিনীর চোয়াল শক্ত। নেত্রী গোছের এক জন রক্তচক্ষু করে চেঁচিয়ে বললেন, ‘‘সব ফুঁকে দেব, উড়ে যাবে।’’ শুনেই আবার উল্লাসে ফেটে পড়ল ভিড়টা। শুরু হয়ে গেল মিছিল।
ইতিমধ্যে হাজির বাইক-বাহিনী। এক-একটি মোটরবাইকে হেলমেটবিহীন তিন জন। সামনে তৃণমূলের পতাকা। পুলিশের নাকের ডগায় কালীঘাট রোডে চক্কর কাটছে বাইক, মুখে স্লোগান। দুমদাম করে কয়েকটা শব্দবাজিও ফাটল। পুলিশের চোখে-মুখে কেমন একটা দিশাহারা ভাব। ততক্ষণে বাইক আর মিছিলে কালীঘাট রোডে যান চলাচল প্রায় স্তব্ধ। ছুটে গিয়ে মিছিলকারীদের কাকুতি-মিনতি করতে লাগল পুলিশ। কে কার কথা শোনে! শেষে ক্লাবঘর থেকে কয়েক জন ছুটে গেলেন বিজয়-উৎসবে মশগুল ভিড়টার দিকে। ‘‘সরে আসুন, সরে আসুন। দিদি উৎসব করতে বারণ করেছেন। নির্দেশ ভাঙবেন না।’’ ভিড় একটু সরল, ধীর গতিতে শুরু হল যান চলাচল। উৎসব অবশ্য থামল না।
বস্তুত, এ দিন এই ‘উৎসব’-এর ভয়েই রোজকার রুটিন বদলে ফেলেন অনেকেই। বহু পরিবারেই শিশুদের স্কুলে পাঠানো হয়নি। সকাল-সকাল বাইরের কাজ সেরে বাড়ি ঢুকে পড়েছেন অনেকেই। আইপিএল-এর টিকিট কাটতে গিয়ে বহু ক্রিকেটপ্রেমী জানতে পেরেছেন, ভোটগণনার জন্য এ দিন টিকিট বিক্রি বন্ধ। আবিরের পাশাপাশি রাস্তায় বেলুন বিক্রি হয়েছে অগুণতি। বেশির ভাগই সবুজ বেলুন!
বিকেলে ৮০ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী নির্দল প্রার্থী আনোয়ার খান মমতার বাড়ি পৌঁছন। তৃণমূলের দলীয় প্রার্থী রাম পিয়ারি রামের স্ত্রী হেমা রামকে হারিয়ে জিতেছেন তিনি। মমতা না থাকলেও ছিলেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তাঁদের প্রণাম করে আনোয়ার জানালেন, তিনি আবার তৃণমূলে যোগ দিতে চলেছেন। তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন মেয়র। পরে বললেন, ‘‘আমরা ১১৪টি ওয়ার্ডে জিতেছি। সেটা এ বার ১১৫ হয়ে গেল।’’
আরও এক বার তিনিই মেয়র হবেন। ভোটের ফল বেরোনোর পরে
দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায়।— নিজস্ব চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রীর নিষেধ অমান্য করা এ দিনের এই উৎসবকে ঘিরে মনে ভয়ও ছিল অনেকেরই। যেমন, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের এক রাস্তায় বক্স বাজিয়ে গান হচ্ছিল, ‘কোই ইঁহা, আহা নাচে নাচে...’। ম্যারাপ বেঁধে প্রস্তুতি চলছিল সান্ধ্য বিজয়োৎসবের। তর সয়নি বলে অনেকে দুপুর থেকেই রাস্তায় নাচতে শুরু করেছিলেন। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা দেখে সামান্য থমকালেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই গান বদলে গেল। বাজতে শুরু করল, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে...।’ নাচ থামিয়ে চেহারাগুলোতেও গাম্ভীর্য।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের দফতরের সামনে তেমন কোনও উচ্ছ্বাস চোখে পড়েনি। দফতরের পাশেই কাঁচামিঠে আম বিক্রি করছিলেন এক প্রৌঢ়। সামনে দাঁড়িয়ে তারিয়ে তারিয়ে আম খাচ্ছিলেন দুই যুবক। বাইকে চড়ে পাশ দিয়ে যেতে যেতে হাতে তৃণমূলের পতাকা ধরা জনা তিনেক যুবক মন্তব্য ছুড়ে গেলেন, ‘‘আমই খাও তোমরা। আঁটি থাকলে সেটাও বাদ দিয়ো না।’’
সকালে কলেজ স্ট্রিটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবশ্য ছিল একেবারে অন্য ছবি। পাশাপাশি ওয়ার্ডের তৃণমূল, বিজেপি আর কংগ্রেস সমর্থকেরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে যে যাঁর প্রার্থীর জন্য উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। পরস্পরের সঙ্গে রসিকতা করছেন, এমনকী ছবিও তুলছেন। সেখানে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরাও দৃশ্যটা দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। তাঁদেরই এক জন আলতো করে বললেন, ‘‘এটাই যদি একমাত্র ছবি হতো, কী ভালই না হতো!’’
কিন্তু এটা যে একমাত্র ছবি নয়, বিকেল হতে না হতেই বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষিপ্ত রাজনৈতিক সংঘর্ষের ছবি সামনে আসতেই তা আরও এক বার পরিষ্কার হয়ে গেল।
কলকাতা আছে কলকাতাতেই!