পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার বাসিন্দা অনির্বাণের কাছে তাই একুশে জুলাই মানে শহিদ সমাবেশের দিন নয়, কাছ থেকে ‘দিদি’কে দেখার দিন। নিজস্ব চিত্র।
একুশে জুলাইয়ের অর্থ কী? জানে না বছর চোদ্দোর অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। তবুও সে বৃষ্টি মাথায় করে বাবার সঙ্গে ঠায় দাঁড়িয়ে ‘দিদি’র ভাষণ শুনছিল।
বাবার মতো অনির্বাণও তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘দিদি’ বলেই ডাকে। বাবার কাছে শুনেছিল, ‘দিদি’র জন্যই সে সাইকেল পেয়েছে। গায়ে স্কুলের জামা উঠেছে। এমনকি, রোজ পেট ভরে যে ‘মিড ডে মিল’ খায়, তা-ও সেই ‘দিদি’র জন্যেই। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার বাসিন্দা অনির্বাণের কাছে তাই একুশে জুলাই মানে শহিদ সমাবেশের দিন নয়, কাছ থেকে ‘দিদি’কে দেখার দিন।
১৯৯৩ সালে একুশে জুলাইয়ের দিন ঠিক কি ঘটেছিল? জানে না অনির্বাণ। বলল, ‘‘বাবা জানে। আমি তো দিদিকে দেখতে এসেছি।’’ আর তার বাবা বললেন, ‘‘গত আট বছর ধরে আসছি। দিদির উন্নয়নে এখন গ্রামবাসীরা খুশি। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। তাই এ বছর ছেলেকে সামনে থেকে দিদিকে দেখাতে নিয়ে এসেছি।”
আরও পড়ুন: দফায় দফায় বৃষ্টি মাথায় করেই ধর্মতলামুখী তৃণমূল কর্মীরা
শনিবার সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার ছিল। দফায় দফায় বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু, তাতে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের উদ্দমে ভাটা পড়েনি। ঠিক যেমন ‘দিদি’র কথা শুনতে বৃষ্টির মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়েছিল অনির্বাণরা। এক বারের জন্য নিজের জায়গা থেকে সরার চেষ্টাই করেননি তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনার কথা আগেই জানিয়েছিল আবহাওয়া দফতর। তাই ব্যাগে করে ছাতা নিয়ে আসতে ভোলেননি কেউ। বৃষ্টি শুরু হতেই কালো মাথার জায়গায়, ধর্মতলা চত্বর নানা রঙের ছাতায় ভরে উঠছিল। যাঁদের কাছে ছাতা নেই, তাঁরা বৃষ্টি মাথায় নেতা-নেত্রীর ভাষণ শুনছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে উঠতেই যেন বাঁধভাঙা আবেগে ভেসে যাচ্ছিলেন তাঁরা।
দেখুন ভিডিয়ো
ভোর থেকে হাওড়া, শিয়ালদহ স্টেশনে যে ট্রেনগুলি আসে, তাতে তিল ধরার জায়গা ছিল না। সকাল ১০টার মধ্যে ধর্মতলায় জনস্রোত। যাঁরা বৃষ্টির জন্য সভামঞ্চে পৌঁছতে পারেননি, রাস্তায় বসানো ‘জায়ান্ট স্ক্রিন’ দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। নদিয়ার মায়াপুর থেকে এসেছিলেন দীপাঞ্জন চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, “দিদি আমাদের কাছে সবার আগে। কিন্তু একুশে জুলাইয়ের একটা উপরি পাওনা রয়েছে। কলকাতায় আসার জন্য টাকা-পয়সা লাগে না। তিন দিন আগে এলেও থাকা-খাওয়ার বন্দবস্ত করে দল। ইচ্ছে হলেই চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া, জাদুঘর ঘুরে দেখা যায়।”
আরও পড়ুন: ২০১৯: তৃণমূলের পাল্টা ব্রিগেড ডাকল বিজেপি, বক্তা মোদী
শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ দিন সকালে বৃষ্টির মধ্যেই শোভাযাত্রা করে এসেছিলেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। ঢাক, ঢোলের শব্দে মনে হচ্ছিল যেন সামনেই পুজো। গোটা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে গত কয়েক দিন ধরেই মানুষ আসছিলেন। বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকেও এসেছিলেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। নিজেদের প্রথা মেনে এ দিন তাঁরা শোভাযাত্রাও করেন। বাঁশবেড়িয়া থেকে আসা দীপাঞ্জন দত্তের কথায়, ‘‘সারা বছর নিজের এলাকায় দলের হয়ে কাজ করে থাকি। এক দিনই ধর্মতলায় মুখ্যমন্ত্রীকে দেখার সুযোগ মেলে। মঞ্চ থেকে আমাদের উদ্দেশে বার্তাও দেন। তাই এই দিনটি আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’
দেখুন ভিডিয়ো
খাওয়া-দাওয়ার কোনও খামতি ছিল না। বাসে, ম্যাটাডোর করে যাঁরা এসেছিলেন, তারা সঙ্গে করে রাঁধুনিও নিয়ে এসেছিলেন। ধর্মতলায় গাড়ি লাগিয়েই রান্নাবান্না শুরু হয়ে যায়। ডিমের ঝোল-ভাত থেকে শুরু করে বিরিয়ানি রান্না করতেও দেখা গিয়েছে। অনেকে আবার প্যাকেট করে খাবার নিয়ে এসেছিলেন। যাঁদের কপালে এ সব জোটেনি, তাঁরা ধর্মতলার ফুটপাত এবং ডেকার্স লেনে গিয়ে পেটপূর্তি করেছেন। দিদির ভাষণ শেষ হতেই অনেকে চট করে ভিক্টোরিয়া, চিড়িয়াখানায় ছুটে গিয়েছেন। এ দিন সকাল ৭টাতেই খুলে দেওয়া হয়েছিল চিড়িয়াখানা। ভিড় কম হয়নি।
আরও পড়ুন: ‘হিটলার-মুসোলিনির থেকেও বড় সম্রাট এসে গিয়েছে’
তবে এ বছর বৃষ্টির জন্য হতাশ হতে হয়েছে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের। একুশে জুলাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি রেকর্ড পরিমাণে বিক্রি হয়। বিক্রি হয় তৃণমূলের টুপি, পতাকা, ব্যাচও। তবে এ বছর তৃণমূল সুপ্রিমোর ছবি বিক্রি করে খুশি হতে পারেননি বিক্রেতারা।
কিন্তু, খুশি অনির্বাণ। বাড়ি যাওয়ার সময় বলল, ‘‘আবার আসব। দিদি বলেছে সামনের বছর আরও বড় সভা হবে।’’