নাছোড়: নিউ টাউনের বেসরকারি হাসপাতালের অনুষ্ঠানে (বাঁ দিক থেকে) আরুষের(ইনসেটে) পিসি জয়িতা রায়, বাবা অভিজিৎ চক্রবর্তী, বোন অদিত্রি এবং মা ছন্দা চক্রবর্তী। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র
বছর চোদ্দোর আরুষ চক্রবর্তীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল ক্যানসার। ‘অ্যাকিউট মায়লয়েড লিউকেমিয়া’র সঙ্গে ২৬ দিনের লড়াইয়ে হেরে গিয়েও জিততে চান বাবা। ক্যানসারের চিকিৎসায় দুঃস্থদের আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি কঠিন সময়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর দল গড়তে ব্রতী হয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী, দমদমের বাসিন্দা অভিজিৎ চক্রবর্তী।
গত মার্চে ক্যানসার ধরা পড়ে আরুষের। ২৬ এপ্রিল নিউ টাউনের টাটা মেডিক্যাল সেন্টারে (টিএমসি) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্রের। প্রতি বছরই ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরিবারগুলির পাশে থাকার বার্তা দিয়ে মিলনোৎসবের আয়োজন করে টিএমসি-র ‘পেডিয়াট্রিক অঙ্কোলজি’ বিভাগ। এ দিন সেই মঞ্চে হাজির হয়ে অভিজিৎ জানান, ডিসেম্বরে আরুষের নামে একটি ট্রাস্ট গড়েছেন তিনি। আর যা বললেন না তা হল, প্রতি সপ্তাহের শনি ও রবিবার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট এবং ঠাকুরপুকুরের ক্যানসার প্রতিষ্ঠানে যান তিনি। পেডিয়াট্রিক অঙ্কোলজি বিভাগে নিজের প্রতিচ্ছবি খোঁজেন। জানতে চান, অন্য কোনও অভিজিৎ অন্য কোনও আরুষের জন্য রক্তের খোঁজ করতে গিয়ে অসহায় বোধ করছেন কি না।
অভিজিতের কথায়, “আজ আরুষ বেঁচে থাকলে ১৪ বছর ৩ মাস ৮ দিন বয়স হত। ওর জন্য ৮০ জন রক্তদাতা আমাকে তৈরি রাখতে হয়েছে। এই রোগে রক্তের জোগান দেওয়াও চ্যালেঞ্জ।” সেই সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নিউ টাউনের তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরা। বাবা কর্পোরেট অফিসের বাইরে বা চায়ের দোকানে গিয়ে ছেলের রক্তের জন্য কাতর আর্জি জানালে তাতে সাড়া দিয়েছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরা। হাজির হয়ে গিয়েছিলেন আরুষকে রক্ত দিতে।
অভিজিৎ বললেন, “ওই ২৬ দিনে বুঝেছি, কঠিন সময়ে কারও পাশে থাকাটা কত জরুরি। ট্রাস্টের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য বড় কথা নয়। আসল কথাটা হল, কঠিন রোগের সঙ্গে লড়াইয়ে পাশে থেকে মনোবল বাড়ানো।”
শুক্রবার বিকেলে বেসরকারি ওই হাসপাতাল চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন অভিজিতের মতো আরও অনেকে। যাঁরা আরুষদের হারতে দিতে চান না। বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র দেবজিৎ পোদ্দার যেমন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া ওই কিশোর তার চিকিৎসক অর্পিতা ভট্টাচার্যের কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘‘আমারই কেন এমন হল?’’ সেই ছেলে এখন ক্যানসারকে পর্যুদস্ত করে রোজগেরে যুবক। এ দিন নিজের উপার্জন থেকে বাকিদের জন্য অর্থসাহায্য করলেন দেবজিৎ। ক্যানসারে আক্রান্ত সন্তানের মায়েদের সমবেত সঙ্গীত, চিকিৎসক পার্থসারথি ভট্টাচার্য ও সুমন পালচৌধুরীর উদ্বোধনী সঙ্গীত এবং সব শেষে মোমের প্রদীপ জ্বালিয়ে জীবনের আবাহন— সব কিছুর মধ্যেই আরুষদের জিতিয়ে আনার নাছোড় জেদের প্রতিফলন ঘটল।
এ দিনের মঞ্চে অভিজিতের স্ত্রী ছন্দা, সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া মেয়ে অদিত্রি ও বোন জয়িতা রায়ও এসেছিলেন। হাজারো আরুষের মধ্যে বেঁচে থাকার যে অঙ্গীকার পরিবার করেছে, তা জানার পরে এক ক্যানসার আক্রান্ত সন্তানের বাবা বললেন, “ওঁর নাম সার্থক হোক, অভিজিৎ।”