পথের কুকুরদের নিয়মিত সেবার ভারও নিয়েছে ‘অবলা’। নিজস্ব চিত্র।
ওরা যে পথকুকুর। আর সে কারণেই জোটে অবিরাম অবজ্ঞা।
‘এই সর’, ‘ভাগ’, ‘দে ব্যাটাদের লেজে ঢিল বেঁধে’, ‘গরম জল ঢেলে দিলে বুঝবে’— এ সব বাক্য তো আছেই। সঙ্গে আছে, ওদের দিকে ঢিল ছোড়া, গায়ে গরম জল বা পেট্রল ছিটিয়ে দেওয়া, লাঠিপেটা করার ঘটনা। কখনও কখনও ধারালো কিছু দিয়ে আঘাতও দৃশ্যও দেখা গিয়েছে এই শহরেই।
ইচ্ছে করে গাড়ির ধাক্কা দেওয়া, কখনও ইচ্ছা বা ইনিচ্ছাকৃত পিষে দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটে। ওরা যে অবলা। তাই এ সবের কোনও ক্ষেত্রেই কারও কোনও শাস্তি হয় না।
পথ কুকুর দের বাটিতে বাটিতে করে খেতে দিচ্ছেন চন্দ্রশেখর বাবু
তবে এই শহরেই অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা ওই অবলাদের জন্যও ভাবেন। ওদের পাশে থাকেন। ভালবাসেন। যত্ন করেন। যেমন দমদম মতিঝিলের বাসিন্দা অপর্ণা মজুমদার। প্রায় এক যুগ আগে ভালবেসে বাড়িতে পোষ্য এনেছিলেন।
সুজাতা দে, চন্দ্রশেখর দে, অপর্ণা মজুমদার, মানস রঞ্জন মজুমদার, স্বাতী দে-এরা আগলে রেখেছেন দমদমের পথকুকুরদের
তার পর থেকে পথকুকুর দেখলেও তার ভাল লাগত। ওদেরও যত্ন করতে ইচ্ছে করত। সেই ভালবাসা থেকেই বাড়ির পোষ্যের সঙ্গে একসঙ্গে খেতে দিতেন পাড়ার কয়েকটা পথকুকুরকে। গত ১২ বছরে সংখ্যাটা ৫ থেকে বেড়ে ৪০০-য় পৌঁছেছে। অপর্ণা দেবীর কথায়, ‘‘পথকুকুরদের ভীষণ সংবেদনশীল বলে মনে হয়। তাই ওদের সঙ্গ ছাড়তে পারিনি আর।’’
আরও পড়ুন: মাটি খুঁড়ে কতটা নীচে নামতে পেরেছে মানুষ...
এখনও ওই ৪০০ পথকুকুরের রোজ দুবেলা খাবার ব্যবস্থা করেন অপর্ণা দেবী। তাদের দেখভালের ব্যবস্থা থেকে চিকিৎসা— সবটাই ওঁদের তত্ত্বাবধানে হয়। ওঁরা বলতে অপর্ণা দেবী, তাঁর স্বামী মানসরঞ্জন মজুমদার, তাঁদের সন্তান, স্বামীর বন্ধু ও তাঁদের ছেলেমেয়েরা। আর এঁদেরকে নিয়েই তৈরি হয়েছে, ‘অবলা’। রাজ্য সরকারি স্বীকৃতিও রয়েছে এই সংস্থার।
মানসরঞ্জন মজুমদার ও অপর্ণা মজুমদার।
কিন্তু, প্রতি দিন দু’বেলা এত পথকুকুরকে কী খাওয়ানো হয়? অপর্ণা দেবী বললেন, ‘‘গোটা দক্ষিণ দমদম, মতিঝিল, বাগুইআটি, লেক টাউন— গোটা এলাকার পথকুকুরদের দুপুরে প্রতি দিন খেতে দেওয়া হয় চিকেনের লিভার এবং হাড়। আর রোজ রাতে মাংস-ভাত। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বাটি রয়েছে।’’ কারা করেন এই খাওয়ানোর কাজ? অপর্ণা দেবীর কথায়, ‘‘মানস এবং আমি ছাড়াও শেখর নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি রয়েছেন। আমাদের ছেলেমেয়ে, বন্ধুরা, সবাই মিলেই চলছে এই কাজ।’’
মানসবাবু সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর অবসরকালীন ভাতার বেশির ভাগটাই এই পথকুকুরদের জন্য বরাদ্দ। তিনি বললেন, ‘‘প্রতি দিন আমাদের বন্ধু শেখর মোটরবাইকে চেপে এলাকা জুড়ে সারমেয়দের খাবার খাওয়াতে যান। অপর্ণা আর আমি পাড়ায় রোজ দুবেলা খাবার বিলি করি।’’
দক্ষিণ দমদমের বিভিন্ন এলাকায় চলে পথের কুকুরদের দেখভাল। নিজস্ব চিত্র।
তবে কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। এখনও প্রতিবেশীদের অনেকেই এই সব কাজের জন্য আপত্তিকর মন্তব্য করেন। তবে সে সবে কান দেয় না ‘অবলা’। শুধু পথকুকুর নয়, যে কোনও নিরাশ্রয় প্রাণীর পাশেই রয়েছে তারা।
বহু বছর ধরে পশুদের অধিকার রক্ষা নিয়ে লড়ছেন অভিনেত্রী তথা তৃণমূলের বিধায়ক দেবশ্রী রায়। কয়েক দিন আগেই তাঁর বাড়ির পোষ্যটি মারা গিয়েছে। পথকুকুরদের নিয়ে এমন সংগঠনের কথা শুনে তিনি বললেন, ‘‘মন খুব খারাপ ছিল। কারণ প্রিয় পোষ্যকে ক’দিন আগে হারিয়েছি। এ রকম খবরে মন ভাল হয়। আমি মনে করি অবলা পশুরা ঈশ্বরের দূত। সর্বত ভাবেই ওদের সাহায্য করা উচিত এবং করতে চাইও।’’
এই শহরে পথকুকুরদের জন্য এমন সংস্থা হয়েছে শুনে খুশি চন্দ্রবিন্দুর গায়ক উপল। তাঁর নিজেরও পোষ্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, পথকুকুরদের নিজের বাড়িতে আশ্রয়ও দিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘‘এ শহরই এমন ভালবাসার কথা ভাবতে পারে।’’ ‘অবলা’ নিয়মিত এলাকার কুকুরদের যত্নের পাশাপাশি নির্বীজকরণের ভার নিয়েছে জেনে অপর্ণা-মানসদের উদ্যোগকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন গায়ক শিলাজিৎও।
আরও পড়ুন: উপলের পুচকি? কী ব্যাপার বলুন তো?
তবে একা ‘অবলা’ নয়, ভবানীপুরের গিরিশ মুখার্জি রোডের একটি সংস্থাও বহু বছর কাজ করছে রাস্তার কুকুরদের নিয়ে। কাজ করছে বেহালা ও সল্টলেকের কয়েকটি সংস্থাও।