জেরম ওয়াটসন ও নিলয় ঘোষ।
উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান তাঁরা। নেশায় বুঁদ, নিয়মিত মাদক বিক্রি করেন। বয়স ১৯ থেকে ২১।
শহরের বিভিন্ন কলেজের পড়ুয়া এমন ৪ জন ছাত্র এবং ২ জন ছাত্রীকে তুলে নিয়ে সারা রাত ধরে রাজারহাটের অফিসে বসিয়ে কাউন্সেলিং করলেন নার্কোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)-র অফিসারেরা। সেই সময়ে পাশে মাথা নিচু করে বসেছিলেন সেই যুবক-যুবতীদের বাবা-মায়েরাও। বাবা-মায়েদের প্রত্যেকেই কর্মরত। আর ওঁরা সবাই বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ছিল পাঁচটি বাঙালি পরিবার।
চাইলে গ্রেফতারও করা যেত তাঁদের। কিন্তু, মাদক-সহ গ্রেফতারের অর্থ, ন্যুনতম ৫ বছরের সাজা। ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। কার্যত, এনসিবি অফিসে ডেকে আনার পরে সেই যুবক-যুবতীদের কয়েক জন এমনটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু, এনসিবি কর্তাদের কথায়, ‘‘এঁদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করাটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। প্রথমে ছাত্রছাত্রী ও পরে তাঁদের বাবা-মাকে ডেকে পাঠিয়ে সারা রাত ঘরে বুঝিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’’ শুধু তাঁরাই নন, কলেজের বহু ছাত্রছাত্রী নিয়মিত মাদক সেবন করছেন এবং বিক্রিও করছেন বলে সেই ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে।
এমন পার্টিতেই ব্যবহার হয় এলএসডি এবং এমডিএমএ জাতীয় মাদক। নিজস্ব চিত্র
মঙ্গলবার সকালে এনসিবি অফিস ছাড়ার আগে ছাত্রছাত্রীরা সবাই মুচলেখা দিয়ে জানিয়েছেন, আর কখনই নেশা করবেন না। মাদক বিক্রির তো প্রশ্নই ওঠে না। তবে বলা হয়েছে, এনসিবি তাঁদের উপরে নজর রাখবে। ২ মাস অন্তর এনসিবি অফিসারের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ করতে হবে। তাঁদের কলেজে কাউকে নেশা করতে দেখলে বা মাদক কেনাবেচা করতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে এনসিবি-কে খবর দেবে।
সোমবার শহরের বিভিন্ন প্রান্তে হানা দিয়ে নার্কোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)-র হাতে ধরা পড়েন দুই মাদক বিক্রেতা। প্রতিষ্ঠিত পরিবারের ২২ বছরের দুই যুবক। সেই নিলয় ঘোষ এবং জেরম ওয়াটসনকে জেরা করে অবাক হয়ে যান এনসিবি অফিসারেরা। জানা যায়, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা, মূলত বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যানেজমেন্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত মাদক সেবন করছেন। শুধু তাই নয়, ছাত্রছাত্রীদের একাংশ নিয়মিত মাদক বিক্রিও করছেন। সেই বিক্রি শুধু নিজের কলেজের সহপাঠীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তা-ও নয়। বাইরের ক্রেতা ফোন করলেও মাদক বিক্রি করেন তাঁরা। ঠিক রুপোলি পর্দায় যেমনটি দেখা যায়, বাস্তবের সঙ্গেও যেন তার বিশেষ হেরফের নেই।
কী ভাবে পাওয়া গেল তাঁদের?
এনসিবি সূত্রের খবর, গত দু’দিন তাঁদের হাতে ধরা পড়া মাদক পাচারকারীদের মোবাইল থেকে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীর ফোন নম্বর পাওয়া যায়। জানা যায়, এঁরা পাচারকারীদের কাছ থেকে নিয়মিত ‘মলি’ ও ‘লুসি’ নিতেন। এমডিএমএ নামে এক ধরনের নেশার ওষুধ দিয়ে তৈরি ক্যান্ডিকে মলি বলা হয়। আর এলএসডি-র ব্লককে লুসি বলে। এনসিবি অফিসারেরা ক্রেতা সেজে ফোন করতে শুরু করেন এই ছাত্রছাত্রীদের। সরাসরি মলি ও লুসি চাইতে ক্রেতার বিস্তারিত পরিচয় না জেনেই রাজি হয়ে যান ওই ৬ জন। কেউ বলেন, ‘‘আমার কাছে ২টো লুসি হবে।’’ কেউ বলেন, ‘‘লুসি নেই, মলি চাই তো বলুন।’’
আরও পড়ুন: বড়দিনের মুখে বাজেয়াপ্ত ১৫ লক্ষের চরস
শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের ডেকে পাঠিয়ে হাতেনাতে ধরে তুলে আনা হয় রাজারহাটে। ঘাবড়ে যান তাঁরা। তাঁদের কাছ থেকে নম্বর চেয়ে প্রত্যেকের বাবা-মাকেও ডেকে পাঠানো হয়। নিজেদের জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে সন্তানের এই বিপথে চলে যাওয়া বেশিরভাগ বাবা-মায়েরই নজর এড়িয়ে গিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ছেলে বা মেয়ে কবে থেকে নেশা করছে, এমনকী হাত খরচের জন্য মাদক বিক্রিও করছেন, তাঁরা স্বপ্নেও ভাবেননি বলে জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার এনসিবি-র পূর্বাঞ্চলের অধিকর্তা দিলীপ শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে যে কলেজগুলির নাম পাওয়া গিয়েছে, সেখানে গিয়ে আমাদের অফিসারেরা সচেতনতা শিবির করবেন। সেই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অধ্যক্ষদেরো বিষয়টি নিয়ে সচেতন করা হবে।’’