শিশু চুরির গুজবের জেরে গণপিটুনির ঘটনার পরে মানুষকে সচেতন করতে লিফলেট বিলি পুলিশের। বৃহস্পতিবার, বারাসতে। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
শিশু চুরির অপবাদে গণপিটুনি দেওয়ায় হাসপাতালে ঠাঁই হয়েছে আমডাঙার বাসিন্দা নেহরা বানুর। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বারাসত মেডিক্যাল কলেজে এখন কাতরাচ্ছেন তিনি। বৃহস্পতিবার হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে নেহরা জানান, বারাসতের কামাখ্যা মন্দির এলাকায় দুপুরে বাস থেকে নেমে খাবারের দোকান খুঁজছিলেন তাঁরা। সেই সময়ে শিশু চুরির অপবাদ দিয়ে স্থানীয় কিছু মানুষ আচমকা তাঁদের উপরে চড়াও হন। কিছু বোঝার আগেই এলোপাথাড়ি মারধর শুরু হয়। গুজবের বশে যে ভাবে নেহরার মাথায় মারা হয়েছে, তাতে তাঁর প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
বারাসতের এই ঘটনায় চিন্তায় পড়েছে প্রশাসনও। নেহরা ও তাঁর দেওর ছাড়া আরও এক জন বুধবার গণপ্রহারে জখম হন। পুলিশ সব মিলিয়ে ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম অভিযুক্ত ছ’জনকে নিজেদের হেফাজতেও নিয়েছে পুলিশ। সমাজমাধ্যমে শিশু চুরির গুজব ছড়ানোর অভিযোগে পায়েল দেবনাথ, প্রীতম মিস্ত্রি ও মিজানুর রহমান নামে তিন জনকে বুধবার রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। সেই সঙ্গে এমন ঘটনা ঠেকাতে পথে নেমে গুজবে কান না দিতে স্থানীয়দের অনুরোধ করেছে তারা। এ দিন বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে পুলিশকর্তারা অভিভাবকদের সঙ্গেও কথা বলেন।
বারাসত পুলিশ জেলার সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়া বলেন, ‘‘যাঁরা এই ধরনের অপরাধ সংঘটিত করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি।’’ ‘বারাসত অলিগলি’, ‘বারাসত’ ও ‘আমাদের শহর বারাসত’— এই তিনটি গ্রুপের বিরুদ্ধে ফেসবুকের কাছে অভিযোগ করে সেগুলির কর্তৃপক্ষকে (অ্যাডমিন) গ্রেফতারের কথা জানানো হবে বলেও জানায় পুলিশ। এ সব সত্ত্বেও ওই এলাকা যে এখনও গুজবের প্রভাবমুক্ত নয়, লোকজনের সঙ্গে কথা বলেই এ দিন তা বোঝা গিয়েছে।
নেহরা এ দিন বলেন, ‘‘দেওরের সঙ্গে এক পিরের কাছে যাচ্ছিলাম। ওই জায়গায় খাবারের দোকান খুঁজতে দাঁড়াই। বাচ্চা নিয়ে এক মহিলা যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতেই দুই টোটোচালক তেড়ে এলেন। আমরা বাচ্চা চুরি করতে ঘুরছি, এই অপবাদ দিয়ে অনেকে জড়ো হয়ে গেলেন। আমাদের বেধড়ক মারা হল।’’ অভিযোগ, নেহরার মোবাইল, নাকছাবি, দুল, টাকা ভিড়ে ছিনতাই হয়েছে। এ দিন বারাসত থানায় নেহরা অভিযোগ দায়ের করেছেন। দেওর খালেদের চোয়ালে চোট থাকায় তিনি কথা বলতে পারছেন না। হাসপাতালের সুপার সুব্রত মণ্ডল বলেন, ‘‘ওঁদের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলেও আঘাত সারতে সময় লাগবে।’’ বারাসতের কাজিপাড়ায় এক বালকের দেহ উদ্ধার হয় গত বৃহস্পতিবার। তার পর থেকেই ওই এলাকায় শিশু চুরির গুজব ছড়াতে থাকে। এক সপ্তাহের মাথায় তিন জন গণপ্রহারে আক্রান্ত হন।
এমন ঘটনার পিছনে পুলিশ গুজবের বিষয়টিকে দায়ী করলেও মনোরোগ চিকিৎসকদের মতে, এর পিছনে থাকে মানুষের ভিতরে লুকনো নৃশংস মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। এসএসকেএম হাসপাতালের মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেলের কথায়, ‘‘ব্যক্তিগত অসহায়তার কারণে বহু মানুষ ক্ষুব্ধ ও হতাশ থাকেন। তাঁরা যখন দেখেন, তাঁদের চেয়েও অসহায় কেউ মার খাচ্ছেন, তখন তাঁদের মনে নৃশংসতা জেগে ওঠে। সুস্থ বুদ্ধি, মায়া-মমতা কমে যায়। এটা সাধারণত দলগত ভাবে কিছু হলেই সে ক্ষেত্রে ঘটে।’’