যেন শবরীমালা, চেতলার কালীপুজোয় প্রবেশ নিষেধ মেয়েদের!

পুজো শুরুর সময়ে তান্ত্রিকেরাই নিদান দিয়েছিলেন যে, এই পুজোয় ঢুকবেন না মেয়েরা। পুজোর এক উদ্যোক্তার কথায়, ‘‘তান্ত্রিকের নিদান মেনেই এখানকার মণ্ডপে মেয়েরা ঢোকেন না।’’

Advertisement

দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:০১
Share:

চেতলা প্রদীপ সঙ্ঘের পুজোয় প্রবেশ নিষেধ মহিলাদের। নিজস্ব চিত্র।

দক্ষিণের শবরীমালা মন্দিরে মেয়েদের ঢুকতে না দেওয়ার নিয়ম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে। সেই নির্দেশ ঘিরে যথেষ্ট বিক্ষোভও হয়েছে দেশ জুড়ে। এ শহরের চেতলা হাট রোডের কালীপুজোয় মেয়েদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অবশ্য কোনও অসন্তোষ পৌঁছয়নি শীর্ষ আদালতের দরজায়। ৩৪ বছর ধরে চলা এই পুজোয় এখনও মেয়েরা নিষিদ্ধই। কারণ, তাঁরা ‘অশুচি’। পুজোর উদ্যোক্তারা বলছেন, তারাপীঠের তান্ত্রিকেরা এসে পুজো শুরু করে যে নিয়ম চালু করেছিলেন, তা মেনে এসেছেন তাঁদের পূর্বপুরুষেরা। সেই নিয়ম বদলের ভাবনা কখনও আসেনি তাঁদের মনেও। তাই বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই বিধি মেনে নিয়েই চলছেন সেখানকার মহিলারাও। যুক্তি, পুজোয় যোগ দিতে গিয়ে ‘অকল্যাণ’ ডেকে আনতে চান না তাঁরা।

Advertisement

শাস্ত্রে অবশ্য মেয়েদের কালীপুজোর মণ্ডপে ঢোকায় কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই বলেই জানা যাচ্ছে। প্রবীণ পণ্ডিত শম্ভুনাথ কৃত্য স্মৃতিতীর্থ বলছেন, ‘‘মহিলারা কালীপুজো করার অধিকারী নন কখনও। কারণ, বীজমন্ত্র উচ্চারণ করার অধিকার তাঁদের নেই। তবে মন্দিরে বা মণ্ডপে যাওয়া নিয়ে কোনও বিধি-নিষেধ নেই মেয়েদের উপরে।’’ তারাপীঠ তারামাতা সেবায়েত সমিতির সভাপতি তারাময় মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘তারাপীঠ তো নয়ই, রাজ্যের কোথাওই এমন নিয়ম নেই।’’ এই কড়াকড়ির কথা শুনে পুরাণ গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলেন, ‘‘বারোয়ারি পুজো কিন্তু সকলের জন্য। সেখানে মেয়ে-পুরুষ ভেদ থাকতে পারে না। আর একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এ ধরনের যুক্তি কোথা থেকে এল? তান্ত্রিক মতে পুজোয় এ রকম কোনও নিয়মের কথা শুনিনি। এটি পুরুষতন্ত্রের উদগ্র প্রকাশ।’’

তবে চেতলার এই রীতি এল কী ভাবে?

Advertisement

চেতলা প্রদীপ সঙ্ঘের বারোয়ারি কালীপুজোর উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, ৩৪ বছর আগে তারাপীঠের তান্ত্রিকেরা এসে শুরু করেছিলেন এই পুজো। তারাপীঠ থেকে তান্ত্রিক এসে এখনও মূলত কালীর পাঁচটি রূপের পুজো করেন এখানে। পূর্বপুরুষদের নিদান মেনে হয় পাঁঠা বলি। পুজো শুরুর সময়ে তান্ত্রিকেরাই নিদান দিয়েছিলেন যে, এই পুজোয় ঢুকবেন না মেয়েরা। পুজোর এক উদ্যোক্তার কথায়, ‘‘তান্ত্রিকের নিদান মেনেই এখানকার মণ্ডপে মেয়েরা ঢোকেন না।’’ তাঁরা জানান, এই পুজোর কোনও জিনিস ছোঁয়ারও নিয়ম নেই মেয়েদের।

আরও পড়ুন: অমিত প্রার্থী বাংলা থেকে, ওড়িশায় মোদী? সভাপতির জন্য ভাবনায় ৩ আসন, জোর জল্পনা

কিন্তু এত বছর আগের সেই নিয়ম বদলে কখনও কি মেয়েদের জায়গা করে দেওয়ার কথাও মনে হয় না উদ্যোক্তাদের? তাঁরাও কি চান মেয়েদের ব্রাত্য রাখতে সেই পুজো থেকে? পুজো কমিটির সম্পাদক মনোজ ঘোষের কথায়, ‘‘আমাদের পূর্বপুরুষদের করে যাওয়া নিয়মে কোনও পরিবর্তন চাই না।’’ তাই সেখানে উদ্যোক্তাদের বাড়ির মহিলারা পর্যন্ত যান না অঞ্জলি দিতে, জানাচ্ছেন ক্লাবের সদস্যেরা।

কিন্তু কালীর সাধনা মানে তো নারীশক্তিরই পুজো। সেই মায়ের পুজো কেন শুরু হল নারীদের বাদ দিয়ে? বদল চাননি মহিলারা? উদ্যোক্তাদের পরিবারের মেয়েরাও কি চান না সেই পুজোর অংশ হয়ে উঠতে? মনোজবাবুর স্ত্রী রুমা ঘোষ বলছেন, ‘‘১৬ বছর হল বিয়ে হয়ে এ পাড়ায় এসেছি। কখনও পুজোয় যাইনি। আমরা গেলে যদি কোনও বিপদ হয়!’’ একই চিন্তা এলাকার অন্য মহিলাদের মনেও। স্থানীয় বাসিন্দা এক মহিলা বলেন, ‘‘এত দিনের নিয়ম ভাঙলে অকল্যাণ হতে পারে।’’ ফলে তাঁরা পুজোর সময়ে উপোস করলেও মণ্ডপে ঢোকার চেষ্টা করতে চান না। অন্য পাড়ায় গিয়ে দিয়ে আসেন অঞ্জলি।

অকল্যাণের ভয় কাটিয়ে নিয়ম অবশ্য সামান্য শিথিল করেছে এলাকারই আর একটি পুজো কমিটি। গত ৪৪ বছর ধরে চলা ৮৬ পল্লির কালীপুজোর মণ্ডপেও ঢোকার নিয়ম নেই মেয়েদের। তবে প্রদীপ সঙ্ঘের মতো কড়াকড়ি আর নেই। ভোগ রান্না কিংবা মণ্ডপের বাইরে দাঁড়িয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে এখন অংশগ্রহণ করতে পারেন মহিলারা। এখানকার পুজো কমিটির সম্পাদক কুণাল বিশ্বাসের কথায়, ‘‘পূর্বপুরুষদের ধারা মেনে আমরা পুজো করে আসছি। তবে একেবারে নিষেধাজ্ঞা বলে কিছু নেই।’’

কিন্তু মেয়েরাই বা ঢুকতে চান না কেন সেখানে? সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ বিষয়টিকে অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক মেয়েরাই নিয়ম ভাঙলে ক্ষতি হওয়ার ভয় পান। বিশ্বাসের মোড়কে এ ভাবেই মনের ভিতরে ভয় বসে গিয়েছে। ফলে এর থেকে মুক্তির উপায় বার করতে হবে সমাজকেই।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement